পার্ল হারবার (Pearl Harbor) হনুলুলুর নিকটে, হাওয়াই (Hawaii) দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত একটি মার্কিন নৌ ঘাঁটি। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর, জাপানি ইম্পেরিয়াল বাহিনী কর্তৃক বিপর্যয়কর এক আক্রমণের স্বীকার হয়েছিলো আমেরিকান এই নৌ-ঘাটি। সেই রবিবার স্বাভাবিক একটি সকালের মাধ্যমেই দিনটি শুরু হয়েছিলো।
ভোরের আলো ফোটার কয়েক ঘন্টা পরে, সকাল আটটার কিছু আগে, কয়েকশ জাপানি যুদ্ধবিমান বিমান পার্ল হারবারে হামলা চালায়। হারবারে অবস্থানরত আটটি যুদ্ধজাহাজ, ৩০০ টির বেশি যুদ্ধ বিমান সমেত প্রায় ২০ টি আমেরিকান নৌযান ধ্বংস হয়ে যায়। বেসামরিক ব্যক্তিসহ জাপানীদের এই হামলায় কমপক্ষে ২৪০০ এরও বেশি আমেরিকান মারা গিয়েছিল এবং আরও প্রায় এক হাজার মানুষ আহত হয়েছিল। এই হামলার পরদিন, রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট মার্কিন কংগ্রেসকে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বলেছিলেন।
এটা খুবই স্বাভাবিক, এবং আমরা জানি এ ঘটনার মাধ্যমে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার অন্তর্ভুক্তি এক প্রকার নিশ্চিত করেছিলো। কিন্তু কেন জাপান আমেরিকার উপর এ ধরণের আগ্রাসন চালিয়েছিল? এটা শুধুই কি জাপানি আগ্রাসন না এর পেছনে আরও কোন কারন লুকিয়ে ছিল সেটাই আজ খোঁজার চেষ্টা করবো।
জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার (Pearl Harbor) আক্রমণের প্রেক্ষাপট
১৯৩০ এর দশকের শেষদিকে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকান বৈদেশিক নীতি চীনকে সমর্থন দিয়েছিলো। জাপান কর্তৃক চীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জাপানকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা দেখা দেয় সে সময়।
১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই বেইজিংয়ের নিকটবর্তী মার্কো পোলো ব্রিজের সংঘর্ষ জাপান এবং ইউনাইটেড ফ্রন্ট অফ জাতীয়তাবাদী এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (United Front of Chinese Nationalists and the Chinese Communist Party) মধ্যে প্রকাশ্য যুদ্ধের সূচনা ঘটায়। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের পাশে দাঁড়ায় এবং সহায়তা হিসেবে ১৯৩৮ সালে চীনে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি করে।
১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে, মার্কিনিরা জাপানের সাথে ১৯১১ সালে সাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়। ১৯৪০ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানে যুদ্ধ সরঞ্জাম রফতানি সীমাবদ্ধ করতে শুরু করে। জাপানের উপর মার্কিনীদের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারনে ১৯৪০ সালের জুন থেকে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশ দুটির মধ্যে ক্রমাগত উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
১৯৪১ সালের জুলাই মাসে জাপানি ইম্পেরিয়াল বাহিনী সমস্ত ইন্দোচিনা অঞ্চল দখল করে নেয় এবং অক্ষ শক্তির (জার্মানি ও ইতালি) সাথে জোট বাঁধে। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সাথে সমস্ত বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। হিমায়িত খাদ্য সামগ্রী, পেট্রোলিয়াম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সামগ্রী জাপানে রপ্তানির উপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়।
আমেরিকার এহেন কার্যক্রম টোকিওর সামরিক বাহিনী খুব ভালভাবে নেয়নি বরং অবিচ্ছিন্নভাবে তারা বিভিন্ন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। চীনকে আমেরিকার আব্যাহত সহায়তায়, তারা তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করেছিল, এবং তারা একটি সিদ্ধান্তে এসেছিলো যে, যত দ্রুত সম্ভব আমেরিকার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক তাদের উপর আক্রমণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, জাপানিরা সুদূর প্রাচ্যে আগ্রাসনের নীতি অনুসরণ করার পক্ষে ছিল। এ সকল উত্তেজনা সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের মধ্যে এক রকম বোঝা পরার অংশ হিসেবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান অনুসন্ধানের আশায় ১৯৪১ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু কোন প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই এটা সমাপ্ত হয়। নভেম্বরের দিকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে দেশ দুটির মধ্যে কোনও চুক্তি সম্ভব নয়।
যদিও জাপান পার্ল হারবার (Pearl Harbor) হামলার পূর্ব দিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিল। তথাপি, প্রধানমন্ত্রী তোজো হিদেকির (Tōjō Hidek) সরকার আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। জাপানের সমন্বিত ফ্লিটের কমান্ডার ইন চিফ, কমান্ডার অ্যাডম ইয়ামামোটো ইসোরোকু (Adm. Yamamoto Isoroku) অত্যন্ত যত্ন সহকারে মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফ্লিটের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন।
হাওয়াইয়ে অবস্থিত মার্কিন সেনা ঘাটিতে এই হামলার আদেশটি ১৯৪১ সালের ৫ নভেম্বর জারি করা হয়েছিল এবং ১৬ নভেম্বর টাস্কফোর্স বাহিনী কুড়িল দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কমান্ডারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যদি আমেরিকার সাথে চলমান আলোচনা ফলপ্রসু হয় তবে নৌবহরটি ফেরত পাঠানো হতে পারে।
২৬ নভেম্বর ওয়াশিংটন ডিসিতে আলোচনার অনুকূল ফলাফলের জন্য ভাইস অ্যাডমিরাল নাগুমো চুইচি একটি বিমান বহরের নেতৃত্বে ছিলেন, যেখানে ৬টি বিমানবাহী ক্যারিয়ার, ২ টি যুদ্ধজাহাজ, ৩টি ক্রুজার এবং ১১ টি ডেস্ট্রয়ার ছিল। তারা হাওয়াইয়ের প্রায় ২৭৫ মাইল উত্তরে অবস্থান নিয়েছিলো।
আরও পড়ুনঃ- এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানি আগ্রাসন সে সময় যেমন ছিল।
পার্ল হারবার (Pearl Harbor) কোথায়?
পার্ল হারবার (Pearl Harbor), যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ২,০০০ মাইল দূরে এবং জাপান থেকে প্রায় ৪,০০০ মাইল দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের কেন্দ্রস্থল হাওয়াইয়ে অবস্থিত। কেউ বিশ্বাস করেনি যে জাপানিরা হাওয়াইয়ের মতো এতো দূরবর্তী দ্বীপগুলিতে আক্রমণ করে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে।
অধিকন্তু, আমেরিকান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এতোটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, কোনও জাপানি আক্রমণ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের নিকটবর্তী এ অঞ্চলে ঘটবেনা।
যেহেতু আমেরিকান সামরিক নেতারা তাদের ভুখন্ডের এত কাছাকাছি কোনও হামলার প্রত্যাশা করছিলেন না, তাই পার্ল হারবারে নৌ-ঘটির নিরাপত্তা ব্যাবস্থা অনেকটাই ঢিলেঢালা এবং অপরিবর্তিত ছিল। প্রায় পুরো প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফ্লিটটি বন্দরের ফোর্ড দ্বীপের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিল, এবং কয়েকশো বিমান, বিমান ঘাটিতে আলস হয়ে পড়েছিল। এ সকল বিষয়, জাপানিদের কাছে পার্ল হারবারকে একটি অপ্রত্যাশিতভাবে সহজ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পরিনত করে।
সতর্কতা এবং প্রতিক্রিয়া
মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফ্লিট ১৯৪০ সালের এপ্রিল থেকে পার্ল হারবারে অবস্থান করা শুরু করে। এখানে ৮ টি যুদ্ধ জাহাজসহ প্রায় ১০০টি নৌ জাহাজ ছাড়াও এখানে যথেষ্ট পরিমানে সামরিক সরঞ্জাম ও বিমান বাহিনী অবস্থান করছিল।
ঐ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ার সময়, অ্যাডমিরাল হাসব্যান্ড ই কিমেল এবং লে জেনারেল ওয়াল্টার সি শর্ট (Adm. Husband E. Kimmel and Lieut. Gen. Walter C. Short), পার্ল হারবারে কমান্ডিং এর দায়িত্ব পালন করছিলেন। তারা জাপানীদের আচরণ বুঝতে পেরে, মার্কিন সামরিক আধিকারিকদের যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন।
বিশেষত ১৬ অক্টোবর এবং পুনরায় ২৬ ও ২৭ নভেম্বর Adm. Husband E. Kimmel একটি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। তিনি নোটিশে বলেছিলেন “এই প্রেরীত বার্তাটিকে একটি যুদ্ধ সতর্কতা হিসাবে বিবেচনা করুন। তিনি আরও বলেছিলেন যে” আলোচনা মূলত ভেস্তে গেছে “। তিনি এ অঞ্চলে উপযুক্ত প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা কার্যকর করার নির্দেশনা চেয়েছিলেন।
মার্কিন সেনাবাহিনী ” কিমেলকে আদেশ দিয়েছিলো যে “আপনি যেটা ভালো মনে করেন তেমনটিই করুন, এবং সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।”
এই সতর্কতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে, সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী কমান্ডাররা যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা যথাযথভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল না। Lieut. Gen. Walter C. Shor জাপানিদের যে কোন হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তার বেশিরভাগ যুদ্ধবিমানকে হুইলারের মাঠে অবস্থিত বিমান ঘাঁটিতে নিয়োজিত করেছিলেন, যাতে হামলার ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা যায়।
তিনি হামলার সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় হিসাবে, প্রতিদিন সকাল ৪.০০ টা থেকে সকাল ৭.০০ টা পর্যন্ত দ্বীপে পাঁচটি মোবাইল রাডার সেট পরিচালনা করার নির্দেশও দিয়েছিলেন।
কিমেলের, গোয়েন্দারা জাপানের বহরের বিশেষত ক্যারিয়ার বিভাগ এবং জাহাজগুলিতে হামলার বিষয়ে কি পরিকল্পনা চলছে তা সনাক্ত করতে সক্ষম হয়নি। তিনি বন্দরের পুরো বহরটিকে (যে অংশটি সমুদ্রের কাছে ছিল) অলস বসিয়ে রেখেছিলেন, এবং কোন ধরণের যুদ্ধ প্রস্তুতিই এ সময় চোখে পরেনি। তিনি তাঁর কর্মীদের একটি অংশকে সৈকতে ছুটিতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।
এই কর্মকর্তাদের কেউই সন্দেহ করেননি যে, এতো দ্রুত পার্ল হারবারের ঘাঁটিতে তাদের উপর আক্রমণ করা হবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ওয়াশিংটনের উর্ধ্বতনরা জাপানীদের আক্রমণের আশঙ্কা সম্পর্কে যে সচেতন ছিলেন, এমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। ২৭ নভেম্বরের যুদ্ধ সতর্কতা এবং খোদ জাপানিদের আক্রমণের ১০ দিনের মধ্যে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে কোনও অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ভোরে ওয়াশিংটন জানতে পারে, জাপানি রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে তাদের পররাষ্ট্র সচিবের সাথে সাক্ষাতের জন্য একটি সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল বেলা ১ টায় (সকাল সাড়ে সাতটা পার্ল হারবার সময়)। এ বার্তাটি ডিকোড করতে কিছুটা সময় লেগেছিল এবং প্রায় সাড়ে দশটা বাজলেও এটি তখনো মার্কিন নৌ-দপ্তরের প্রধানের হাতে এসেছিলোনা।
সকাল ৯.০০ টা থেকে ১০.০০ টার মধ্যে খবরটি মার্কিন যুদ্ধ বিভাগে সরবরাহ করা হয়েছিল। মার্কিন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ (U.S. Army chief of staff) জেনারেল জর্জ সি মার্শাল, সোয়া ১১ টার দিকে অফিসে পৌঁছানোর পর বর্তাটি দেখতে পান।
নৌ অভিযানের প্রধান অ্যাডমিরাল হ্যারল্ড স্টার্ক তখনও ভাবেননি যে, কিমেলের কাছে কোনও অতিরিক্ত নির্দেশনা পাঠান হয়নি। তবে মার্শাল নতুন একটি সতর্কতা প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং নৌবাহিনীর সাথে যোগাযোগের জন্য সামরিক কমান্ডকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর কথাগুলি আটকে যেতে পারে এই ভয়ে টেলিফোন করেননি এবং তার পরিবর্তে টেলিগ্রামের মাধ্যমে বার্তাটি প্রেরণ করেছিলেন।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ ধরণের বিভ্রান্তির পর এবং আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোন প্রকার সতর্কতা হাওয়াইতে পৌঁছায়নি। এটা লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, জাপানি বিমানগুলি ঘাঁটিতে প্রবেশের এক ঘন্টা আগে পার্ল হারবারের (Pearl Harbor) সেনা আধিকারিকরা জানতে পারেছিলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে হামলা হতে চলেছে।
পার্ল হারবার (Pearl Harbor) হামলার নির্ধারিত সময়ের চার ঘন্টা আগে, একটি জাপানি সাবমেরিন মাইনসুইপার ইউএসএস কনডোরের চোখে পরে। এর প্রায় আড়াই ঘন্টা পরে, ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস ওয়ার্ডের কমান্ডার একটি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন, তিনি পার্ল হারবারের নিকটে ” আক্রমণাত্মক সমুদ্র অঞ্চলে একটি জাপানি সাবমেরিন দেখতে পেয়েছেন। তিনি এর উপর আক্রমণ করেছিলেন, গুলি চালিয়েছিলেন এবং সাবমেরিন লক্ষ্যকরে বোমা চার্জ করেছিলেন।
কিমেল এই প্রতিবেদনের নিশ্চয়তা কতটা, সে অপেক্ষা করতে করতেই জাপানিরা পার্ল হারবারে (Pearl Harbor) আক্রমণ শুরু করেছিল। এই সকালে, মার্কিন সেনা প্রাইভেট জর্জি এলিয়ট, রাডার অনুশীলন করে পর্দায় তাদের দিকে অগ্রসরমান বিমানের একটি বিশাল বহর লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি যখন তার লেফটেন্যান্টকে টেলিফোন করেছিলেন, তখন তাকে এই পর্যবেক্ষণ উপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল।
আরও পড়ুনঃ- ডি-ডে (D-Day), নরম্যান্ডির এ যুদ্ধটি ছিল পৃথিবীকে বদলে দেয়ার একটা দিন
পার্ল হারবারে (Pearl Harbor) জাপানীদের হামলা
স্থানীয় সময় সকাল ৭.৫৫ মিনিটে প্রথম পার্ল হারবারের আকাশে জাপানি ডাইভ-বোমারু বিমানগুলো উপস্থিত হয়। টর্পেডো প্লেন, বোমারু বিমান এবং ফাইটার বিমানসহ প্রায় ২০০ টি বিমানের একটি বহর হামলায় প্রথম অংশ নিয়েছিল। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে মার্কিন বেসের বিভিন্ন বিমান ক্ষেত্রগুলি বর্বর হামলার শিকার হয়।
Lieut. Gen. Walter C. Shor এর নির্দেশে মার্কিন সামরিক বিমানগুলি ফোর্ড দ্বীপের নেভাল এয়ার স্টেশন এবং এ সংলগ্ন হুইলার ও হিকাম ক্ষেত্রগুলিতে একসাথে রেখে দেয়া হয়েছিল। এসব স্থানে জাপানি এয়ার স্ট্রাইকের ফলে মাটিতেই অনেক বিমান ধ্বংস হয়ে যায়।
বিশেষত হুইলারের মাঠের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম ছিল অনেক ভয়ঙ্কর। মাটিতে থাকা ১২৬ টি বিমানের মধ্যে ৪২ টি বিমান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, ৪১ বিমান টি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এবং মাত্র ৪৩ টি বিমান ব্যাবহার উপযোগী ছিল। এই প্রথম আক্রমণটির প্রতিউত্তর হিসেবে কেবল মাত্র ৬টি মার্কিন বিমান আকাশে উরেছিল। পার্ল হারবারের (Pearl Harbor) এ হামলায় মোট, ১৮০ টিরও বেশি বিমান ধ্বংস হয়ে যায়।
একই সময়ে কিমেলের অধীনে থাকা নৌ বহরের বিরুদ্ধে জাপানি বাহিনী একটি বিশাল হামলা শুরু করে। বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজগুলি জাপানি বোমা হামলাকারীদের জন্য নিখুঁত লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছিলো। যেহেতু এটি ছিল রবিবারের সকাল, সেহেতু জাপানিরা হামলার জন্য এ সময়টিকেই বেছে নিয়েছিলো। যুদ্ধজাহাজের বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতি হামলার প্রথম ৩০ মিনিটেই হয়ে যায়। হারবারে অবস্থান করা যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস অ্যারিজোনা (USS Arizona) এক অসাধারণ বিস্ফোরণে উড়ে যায়।
এরপর একে একে ইউএসএস ওকলাহোমাকে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে চারটি টর্পেডো আঘাত করেছিল, এবং সম্পূর্ণরূপে ঘূর্ণায়মান, এটির প্রপেলার বন্দরের পানির উপরে উঠে যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধ জাহাজ, ইউএসএস ক্যালিফোর্নিয়াকে টর্পেডো অঘাত করে এবং ধীরে ধীরে এটি সৈকতের অগভীর পানিতে ডুবে যায়।
ইউএসএস উটাহও জাপানীদের হামলায় ডুবে গিয়েছিল। রক্ষা পাওয়া কয়েকটি জাহাজের অ্যান্টিএয়ার ক্রাফট ক্রুরা পাল্টা জবাব দেয়ার জন্য মোটামুটি তৎপর ছিল এবং সেনা কর্মীরা গুলি চালিয়েছিল, তবে জাপানি আক্রমণ কোনভাবেই বাধাগ্রস্থ হয়নি।
সকাল সাড়ে ৮ টায় দ্বিতীয় আক্রমণটি শুরু হয়। প্রথমটির চেয়ে কম সফল হলেও, এটি প্রচুর ক্ষতি সাধন করে। সকাল ৯ টা নাগাদ জাপানিরা হামলা থামিয়ে দেয়।
আরও পরুনঃ- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা এবং সমাপ্তি
পার্ল হারবারের (Pearl Harbor) আক্রমণ এর প্রভাব
পার্ল হারবারের (Pearl Harbor) হামলায়, জাপানিরা যে এরকম দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করবে তা কেউ সন্দেহও করতে পারেনি। হামলায় অ্যারিজোনা এবং ওকলাহোমা ধ্বংস হয়ে যায় এবং ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। অন্যান্য ছয়টি যুদ্ধজাহাজ বিভিন্ন ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। তিন ক্রুজার, তিনটি ডেস্ট্রয়ার এবং অন্যান্য জাহাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
মার্কিন সেনা হতাহতের সংখ্যা ২,৪০০ এরও বেশি ছিল এবং ৩,৪০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছিলো। সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী বিমান উভয়কেই প্রচুর পরিমানে ক্ষতি গুনতে হয়েছিল। যুদ্ধে জাপানিরা ২৯ থেকে ৬০ টি বিমান হারায়। এছাড়া পাঁচটি মিডজেট সাবমেরিন, এবং ১০০ এরও কম লোককে হারিয়েছিল তারা। জাপানি টাস্কফোর্স আক্রমণ না করে যুদ্ধের ময়দান থেকে অবসর নিয়েছিল।
তবে এরকম ট্র্যাজেডির পরও একটি সান্ত্বনাও মার্কিন বেস পেয়েছিলো। কিমেলের তৎপরতার ফলস্বরূপ, দুটি মার্কিন বিমানবাহি রণতরী হামলার সময় বন্দরে ছিল না। অ্যাডম উইলিয়াম এফ হ্যালসির নেতৃত্বে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ সামুদ্রিক বিমান এবং বিমানচালক নিয়ে ওয়েক আইল্যান্ড গ্যারিসনকে আরও শক্তিশালী করার মিশনে ছিল।
ইউএসএস লেক্সিংটন মিডওয়েতে মেরিন ডাইভ-বোমারু বিমান চালানোর জন্য অনুরূপ মিশন হাতে নিয়েছিল। এদের ৬ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে ফিরে আসার কথা ছিল, তবে বিরুপ আবহাওয়ার কারণে তাদের ফিরতে দেরি হয়ে যায় এবং এর ফলে সেগুলো রক্ষা পায়।
আক্রমণ পরবর্তী মার্কিন তৎপরতা
পার্ল হারবারের (Pearl Harbor)র উপর ক্রাশিং হামলার পরদিন, অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট মার্কিন কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনের ডাক দিয়েছিলেন।
অধিবেশনে তিনি দৃঢ় ভাবে বলেন “গতকাল, ৭ ডিসেম্বর, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কুখ্যাত তারিখ, যেদিন জাপানের নৌবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের উপর আক্রমণ করেছিল।”
তিনি আরও বলেছিলেন, “আমাদের এই আক্রমণটি কাটিয়ে উঠতে যতই সময় লাগুক না কেন, আমেরিকার জনগণ তাদের ধার্মিয় বিশ্বাস দ্বারা একসময় নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করবে। আমি বিশ্বাস করি যে, মার্কিন কংগ্রেস এবং জনগণের ইচ্ছার মূল্য সর্বাত্মক ভাবে দেয়ার চেস্টা করা হবে। আমরা একটা বিষয় নিশ্চিত করব, এই বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের আর কখনও বিপন্ন করবে না। “
আরও পরুনঃ- ডানকির্কের যুদ্ধ (Battle of Dunkirk), এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর নব-উত্থান
আমেরিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রবেশ
পার্ল হারবার আক্রমণের পর এবং পূর্ববর্তী কয়েক বছর ধরে জাপানের সাথে আলোচনা ও বিতর্কের সময় প্রথমবারের মতো আমেরিকান জনগণ যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
জাপানিরা তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি তুলে নেওয়ার লক্ষে একটি চুক্তিতে আসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু কোন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ফলপ্রসু না হওয়ায় জাপান তাদের প্রতিপক্ষকে একটি বৈশ্বিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক জাপানের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণার বিরুদ্ধে একটি ভোট পড়েছিলো। মন্টানার প্রতিনিধি জ্যানেট র্যাংকিং (Jeannette Rankin) ছিলেন এক উদারপন্থী নেতা, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান প্রবেশের বিরুদ্ধেও ভোট দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন “একজন মহিলা হিসাবে আমি যুদ্ধে যেতে পারি না, এবং অন্য কাউকে পাঠাতে অস্বীকার করি।”
৮ ডিসেম্বর ১৯৪১, মার্কিন কংগ্রেস ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণাকে অনুমোদন দিয়েছিল। এর তিন দিন পরে, জাপানের ঘনিষ্ঠ মিত্র জার্মানি এবং ইতালি আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়।
দ্বিতীয়বারের মতো, কংগ্রেস ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দু’বছরেরও বেশি সময় পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে প্রবেশ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের একমাত্র কারন ছিল জাপান কর্তৃক পার্ল হারবারে (Pearl Harbor) আক্রমণ। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, পার্ল হারবারে (Pearl Harbor) আক্রমণ করে জাপান এ ধরণের ভুল না করলে জাপানি আগ্রাসন কোথায় গিয়ে থামত সেটা অবশ্যই ভাবার বিষয়।
তথ্যসূত্রঃ- https://www.britannica.com/event/Pearl-Harbor-attack/The-attack
https://en.wikipedia.org/wiki/Attack_on_Pearl_Harbor
https://www.history.com/topics/world-war-ii/pearl-harbor
https://www.thoughtco.com/pearl-harbor-facts-1779469
https://www.nps.gov/valr/index.htm
https://www.khanacademy.org/humanities/us-history/rise-to-world-power/us-wwii/a/pearl-harbor