966px-Ww2_158.jpg

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা এবং সমাপ্তি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) ফলে ইউরোপে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তার সুত্র ধরেই পৃথিবী বিশ্বযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় পরিলক্ষিত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দুই দশক পরে শুরু হয়েছিল নিজেকে আরও ভয়াবহ প্রমাণ করতে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল জার্মানির ক্ষমতায় এসে অ্যাডলফ হিটলার এবং তার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক (নাৎসি পার্টি) জার্মান জাতিকে এই বেহাল অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার করেছিল। সেই সাথে বিশ্বে জার্মান আধিপত্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও এগিয়ে নিতে ইতালি ও জাপানের সাথে কৌশলগত চুক্তি সম্পাদন করেছিলো।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে হিটলারের পোল্যান্ডে আক্রমণ গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা এনে দেয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল এভাবেই। পরবর্তী ছয় বছর ধরে, এই ভয়াবহ মানব সৃষ্ট বিপর্যয় আগের যে কোনও যুদ্ধের চেয়ে আরও বেশি প্রাণ নিয়েছিল এবং বিশ্বজুড়ে আরও বেশি মানব সভ্যতা ধ্বংসের নেশায় মেতে উঠেছিলো।

হিটলারের নারকীয় “ফাইনাল সলিউশন,” যা হলোকাস্ট হিসাবে পরিচিত, তার অংশ হিসাবে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আনুমানিক ৬০ লক্ষেরও বেশি ইহুদী নিহত হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট

Ww2_allied_advance_siegfried_line.jpg
Ww2_allied_advance_siegfried_line

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ইউরোপকে প্রচণ্ড অস্থিতিশীল করে তুলেছিল সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সব দিক দিয়েই। এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই সমস্যাগুলির দ্বারাই উত্থিত হয়েছিল।

আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে সমাপ্ত হলেও সেই সংঘাতের বেশ কিছু অনানুষ্ঠানিক অমীমাংসিত বিষয় রয়ে গিয়েছিল। বিশেষত, জার্মানিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ভার্সাই চুক্তির দ্বারা জার্মানির উপর আরোপিত কঠোর শর্তের বেড়াজাল, অ্যাডলফ হিটলার এবং তার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক (নাৎসি) পার্টির ক্ষমতার আসা এবং তাদের উত্তরোত্তর উত্থানকে অনেক বেশি তীব্র করে তুলেছিল।

আপনি কি জানেন? ১৯৩৩ সালের প্রথম দিকে, অ্যাডলফ হিটলার তাঁর স্মৃতিচারণ ও প্রচারমূলক আত্ম জীবনী “মেইন ক্যাম্পফ” (আমার সংগ্রাম) -এ একটি সাধারণ ইউরোপীয় যুদ্ধের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি আভাস দিয়েছিলেন “জার্মানিতে ইহুদি জাতির নির্মূল” হতে হবে।

১৯৩৩ সালে রাইখ চ্যান্সেলর হওয়ার পরে, হিটলার দ্রুততার সাথে একীভূত ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি নিজেকে ফুয়েরার (সর্বোচ্চ নেতা) হিসাবে অভিসিক্ত করেন। “খাঁটি” জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিটলার বিশ্বাস করেছিলেন যে, যুদ্ধই ছিল জার্মান জাতির সম্প্রসারণ বা জায়গা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় “লেবেনস্রাম” একমাত্র উপায়।

১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি গোপনে ভার্সেস চুক্তি লঙ্ঘন করে জার্মানির পুনঃবিন্যাস শুরু করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ইতালি ও জাপানের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার পরে হিটলার ১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়া দখল করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন এবং পরের বছর চেকোস্লোভাকিয়াকে জার্মানির সঙ্গে যুক্ত করেন।

হিটলারের এ ধরণের প্রকাশ্য আগ্রাসন রোধ করার জন্য কোনপ্রকার আন্তর্জাতিক কার্যক্রম সেভাবে গ্রহণ করা হয়নি। কারন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতর দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছিল এবং ফ্রান্স ও ব্রিটেন উভয়ই (প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দুটি দেশ) তাৎক্ষনিক যুদ্ধের জন্য আগ্রহী ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত যেভাবে হয়েছিলো (১৯৩৯)

১৯৩৯ সালের আগস্টের শেষের দিকে হিটলার এবং সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন জার্মান-সোভিয়েত নোনাগ্রেশন চুক্তিতে (Nonaggression Pact) স্বাক্ষর করেন, যা লন্ডন এবং প্যারিসে উদ্বেগের উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। হিটলার দীর্ঘদিন ধরে পোল্যান্ড আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিলেন।

এটি এমন একটি দেশ, যেখানে গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স আক্রমণ করলে, জার্মানি সামরিক সহায়তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। স্টালিনের সাথে নোনাগ্রেশন চুক্তির অর্থ হল, পোল্যান্ড আক্রমণ করার পরে হিটলার দুটি ফ্রন্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুখোমুখি হবেন না এবং জাতির পরাজয় ও বিভাজনে সোভিয়েত সহায়তা পাবেন।

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, হিটলার পশ্চিম দিক থেকে পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিলেন। এর দু’দিন পরে ফ্রান্স ও ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ করে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে।

১৭ সেপ্টেম্বর, সোভিয়েত সৈন্যরা পূর্ব থেকে পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিল। উভয় পক্ষের আক্রমণে পোল্যান্ড দ্রুত জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। নোনাগ্রেশন চুক্তিতে উল্লিখিত একটি গোপন প্রোটোকল অনুসারে ১৯৪০ এর গোড়ার দিকে জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এই জাতির উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল।

এরপর স্ট্যালিনের সোভিয়েত বাহিনী বাল্টিক অঞ্চলগুলি (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া) দখল করতে অগ্রসর হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রুশ-ফিনিশ যুদ্ধে প্রতিরোধী ফিনল্যান্ডকে পরাজিত করে। পোল্যান্ড আক্রমণের পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পশ্চিমের মিত্র দেশগুলির পক্ষ থেকে জার্মানির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপের না নেওয়ায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এটাকে একটি “নোংরা যুদ্ধ” বলে অভিহিত করা হয়েছিলো।

তবে সমুদ্রে, ব্রিটিশ এবং জার্মান নৌবাহিনী একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল। এ সময় জার্মানির ১০০ টিরও বেশি ইউ-বোট (সাবমেরিন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম চার মাসের মধ্যে ডুবে যায় এবং বেশ কিছু ব্রিটিশ বানিজ্য জাহাজকে জার্মানরা ডুবিয়ে দিয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপ পরিস্থিতি (১৯৪০-৪১)

170602-G-XX000-001.jpg
Injuries soldier

১৯৪০ সালের ৯ এপ্রিল জার্মানি একসাথে নরওয়ে আক্রমণ করে, এবং পড়ে ডেনমার্ক দখল করে, সেই সাথে যুদ্ধটি নতুন উদ্যমে শুরু হয়। ১০ ই মে, জার্মান বাহিনী বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসে অভিযান চালিয়েছিল যা “ব্লিটজ্রেইগ” বা বজ্রযুদ্ধ হিসাবে পরিচিত। এর তিন দিন পরে, হিটলারের সৈন্যরা মিউস নদী পেরিয়ে ফরাসী সেনাদের আক্রমণ করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে, সে সময় জার্মানরা তাদের ট্যাঙ্ক এবং বিমান দিয়ে ম্যাজিনোট লাইনটি ভেঙে ফেলেছিল এবং এটিকে অকেজো করে দিয়েছিল। এদিকে যখন দক্ষিণে ফরাসি বাহিনী একটি কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল জার্মানদের বিরুদ্ধে, তখন ব্রিটিশ এক্সপিডিশনারি ফোর্স (বিইএফ) মে মাসের শেষদিকে ডানকর্ক থেকে তাদের কোণঠাসা হয়ে যাওয়া সৈন্যদের সমুদ্র পথে সরিয়ে নিয়েছিল।

যুদ্ধে ফ্রান্সের পতনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে, ইতালির বেনিটো মুসোলিনি হিটলারের সাথে তার চুক্তি কার্যকর করে এবং ইটালি ১০ জুন ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

১৪ ই জুন, জার্মান বাহিনী প্যারিসে প্রবেশ করেছিল। মার্শাল ফিলিপ পেটাইন (ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নায়ক) দ্বারা গঠিত একটি নতুন সরকার আগ্রাসি জার্মানদের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ করতে পেরেছিল।

পরবর্তীকালে ফ্রান্সকে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়, যার একটি জার্মানির সামরিক দখলদারীর অধীনে এবং অন্যটি ফিলিপ পেটাইন সরকারের অধীনে। ফ্রান্সে প্রভাব বিস্তারের পর, হিটলার ব্রিটেনের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন, তবে ব্রিটেন ইংলিশ চ্যানেলের মাধ্যমে পৃথক হওয়ায় প্রতিরক্ষামূলক কিছু সুবিধা পেয়েছিল।

ব্রিটেনের উপর আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত করার জন্য, জার্মান বিমানগুলি ১৯৪০ সালের পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে ব্রিটেনে ব্যাপকভাবে বোমা ফেলেছিল। লন্ডন এবং অন্যান্য শিল্পকেন্দ্রগুলিতে রাতে জার্মান অভিযানের কারনে অনেক বেসামরিক মানুষ হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।

ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্স (আরএএফ) শেষ পর্যন্ত জার্মান বিমানবাহিনীকে পরাজিত করে এবং এরই সাথে হিটলার ব্রিটেন আক্রমণ করার পরিকল্পনা স্থগিত করে দেয়। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামূলক সংস্থান সীমাবদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪১ সালের গোড়ার দিকে কংগ্রেস কর্তৃক পাস হওয়া লেন্ড-লিজ আইন অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জরুরী সহায়তা গ্রহণ করা শুরু করেন।

অপারেশন বার্বারোসা (১৯৪১-১৯৪২)

ww2-528872_960_720.jpg
ww2- German Soldiers

১৯৪১ সালের গোড়ার দিকে, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া অক্ষশক্তিতে যোগ দিয়েছিল এবং জার্মান সেনারা সেই এপ্রিলে যুগোস্লাভিয়া এবং গ্রিসকে পরাস্ত করেছিল। হিটলারের বালকান অঞ্চল বিজয়ই ছিল আসল উদ্দেশ্য।

হিটলারের অন্যান্য কৌশলের অংশ ছিল জার্মান-অধিকৃত ইউরোপ জুড়ে বসবাসকৃত ইহুদীদের নির্মূল করা। “চূড়ান্ত সমাধান” করার পরিকল্পনা সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়কালে শুরু হয়েছিল এবং এ সময় জার্মান নাৎসি বাহিনীর মূল লক্ষই ছিল পরবর্তী তিন বছরে জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে ডেথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত করা এবং সেখানে বসবাসরত প্রায় ৩৩ লক্ষেরও বেশি ইহুদীদের হত্যা করা।

১৯৪১ সালের ২২ শে জুন, হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার নামকরণ করা হয়েছিল অপারেশন বারবারোসা।

সোভিয়েত বাহিনীর ট্যাঙ্ক এবং বিমান, জার্মানদের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ছিল, তবে তাদের এয়ার প্রযুক্তি বেশিরভাগই ছিল অপ্রচলিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের এহেন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, আশ্চর্য আক্রমণের মধ্যদিয়ে জার্মানরা জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ মস্কোর ২০০ মাইলের মধ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। হিটলার এবং তার সেনাপতিদের মধ্যে কিছু মত পার্থক্যের দরুন পরবর্তী জার্মান আগ্রাসনটি অক্টোবরের পূর্ব পর্যন্ত স্থগিত ছিল। এ সময়ের মধ্যে সোভিয়েত বাহিনী জার্মানদের উপর পাল্টা আক্রমণ করে। তবে ইউরোপের প্রচন্ড শীতের কারণে যুদ্ধকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

প্রশান্ত মহাসাগরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৪১-১৯৪৩)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি এবং ব্রিটেন মুখোমুখি হওয়ার সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সে সময় একমাত্র জাতি ছিল যারা জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৪১ সালের শেষদিকে চীনের সাথে জাপানের সে সময়ে চলমান যুদ্ধের বিস্তৃতি সুদূর পূর্বের ইউরোপীয় উপনিবেশিক অঞ্চলে জাপানি দখল দারিত্তকে উৎসাহিত করেছিল।

১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর, জাপানের ৩৬০ টি বিমান পার্ল হারবারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ করে আমেরিকানদের পুরোপুরি অবাক করে দেয়। এ সময় ২,৩০০ এরও বেশি সৈন্য জীবন হারায়। পার্ল হারবারের উপর আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনীদের প্রবেশের পক্ষে আমেরিকার জনমতকে একীভূত করেছিল।

ফলশ্রুতিতে, ৮ ই ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেস জাপানের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন ভোটের মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই সাথে জার্মানি এবং সহযোগী অন্যান্য অক্ষ শক্তিগুলি তাত্ক্ষণিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়।

মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফ্লিট ১৯৪২ সালের জুনে জাপানীদের বিরুদ্ধে মিডওয়ের যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। দক্ষিণ সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম গুয়াদলকানালে, মিত্রশক্তিরা ১৯৪২ সালের আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই জোয়ারকে আরও গতিশীল করে জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করতে থাকে।

১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিত্র নৌবাহিনীর জোট জাপানের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছিল, তাতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের অধীনে থাকা মূল দ্বীপগুলি জাপানের হাতছারা হতে থাকে। এই “দ্বীপ-হপিং” কৌশলটি সফল প্রমাণিত হয়েছিল এবং মিত্রবাহিনী জাপানিদের স্বদেশে আক্রমণ করার চূড়ান্ত লক্ষ্যের নিকটে চলে যায়।

আরও পড়ুনঃ- এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানি আগ্রাসন সে সময় যেমন ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র জটের জয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত (১৯৪৩-১৯৪৫)

উত্তর আফ্রিকাতে, ব্রিটিশ এবং আমেরিকান বাহিনী ১৯৪৩ সালে ইতালীয় এবং জার্মানদের পরাজিত করে। সিসিলি ও ইতালিতে মিত্র জটের একটি আক্রমণ হয়েছিল, এর ফলে  ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে মুসোলিনী সরকারের পতন ঘটে, যদিও ইতালিতে জার্মানদের বিরুদ্ধে মিত্রদের যুদ্ধ ১৯৪৫ সাল অবধি অব্যাহত থেকেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে, ১৯৪২ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া একটি সোভিয়েত পাল্টা আক্রমণ স্ট্যালিনগ্রাদের রক্তাক্ত যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল। এখানে তীব্র যুদ্ধের ভয়াবহতা কিছুটা হলেও দেখেছিল পুরোবিশ্ব।

ক্রমহ্রাসমান খাদ্য এবং চিকিত্সা সরবরাহের সাথে প্রচন্ড শীতের ফলে সেখানে জার্মান সেনাদের শেষ আশাটুকু শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারী জার্মানরা সোভিয়েত ইউনিয়নে আত্মসমর্পণ করেছিল।

১৯৪৪ সালের ৬ জুন-কে “ডি-ডে” (D-Day) হিসাবে উদযাপন করা হয়। ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডির সমুদ্র সৈকতে ১,৫৬,০০০ ব্রিটিশ, কানাডিয়ান এবং আমেরিকান সেনা অবতরণ করে জার্মানির বিরুদ্ধে বিশাল আক্রমণ শুরু করে। জবাবে, হিটলার পূর্বের জার্মানির পরাজয়ের চিন্তা না করে, তার সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট সমস্ত শক্তি পশ্চিম ইউরোপে পাঠিয়ে দেন।

ইতোমধ্যে, সোভিয়েত সেনাবাহিনী পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি এবং রোমানিয়ায় অগ্রসর হয়েছিল। এ সময় হিটলার যুদ্ধের সর্বশেষ বড় জার্মান আক্রমণ (ডিসেম্বর ১৯৪৪ থেকে জানুয়ারী ১৯৪৫ পর্যন্ত) পরিচালিত করেছিলো।

১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মান ভূমিতে মিত্রদের আগ্রাসনের আগে একটি তীব্র বিমান হামলা হয়েছিল এবং ৮ ই মে জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের সময় সোভিয়েত বাহিনী দেশের বেশিরভাগ অংশ দখল করে নেয়। অ্যাডলফ হিটলার, ৩০ এপ্রিল তার বার্লিনের বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেছিলেন। 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি (১৯৪৫)

german-wwii-military-ww2.jpg
german-wwii-military-ww2

১৯৪৫ সালের জুলাই-আগস্টে পটসডাম সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুমান (যিনি এপ্রিল মাসে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের মৃত্যুর পরে দায়িত্ব নিয়েছিলেন), চার্চিল এবং স্টালিন জাপানের সাথে চলমান যুদ্ধের পাশাপাশি জার্মানির সাথে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।

যুদ্ধোত্তর জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চারটি অঞ্চলে বিভক্ত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। পূর্ব ইউরোপের ভবিষ্যতের বিভাজনমূলক বিষয়ে, চার্চিল এবং ট্রুমান স্ট্যালিনকে সঙ্গে নিয়েছিলেন, কারণ তখন তাদের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সোভিয়েতের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল।

আইও জিমা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫) এবং ওকিনাওয়া (এপ্রিল-জুন ১৯৪৫) এর যুদ্ধে প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে। এসব সত্ত্বেও জাপানের স্থল আগ্রাসনের আশঙ্কায় ট্রুমানকে একটি নতুন এবং ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ব্যবহারের অনুমোদন দিতে হয়।

দ্য ম্যানহাটন প্রকল্প নামে একটি শীর্ষ গোপন অপারেশনে উৎপাদিত, লিটন বয় ও ফ্যাট্ম্যান নামক পরমাণু বোমা দুটি আগস্টের গোড়ার দিকে জাপানের শহর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ফেলা হয়েছিল। ১৫ ই আগস্ট, জাপানী সরকার একটি বিবৃতি জারি করে যে, তারা পটসডাম ঘোষণার শর্তাদি মেনে নেবে এবং ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর, জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারের নিকট টোকিও বেতে ইউএসএস মিসৌরি জাহাজে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাণহানি ও পরবর্তী পরিস্থিতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক আন্তর্জাতিক সংঘাত হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। ৬ থেকে ৮ কোটি মানুষ এ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে ৬০ লক্ষেরও বেশি ইহুদী জনগোষ্ঠী যারা হলোকাস্টের সময় নাৎসিদের হাতে মারা গিয়েছিল।

যুদ্ধে প্রায় ৫ থেকে ৫.৫ কোটি  বেসামরিক নাগরিক মারা যায়, এবং যুদ্ধের সময় নিহতদের মধ্যে ২.১ থেকে ২.৫ কোটি সামরিক সদস্য প্রাণ হারায়। এছাড়া আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ আহত হয়, এবং আরও বেশি লোক তাদের ঘরবাড়ি এবং সম্পত্তি হারায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিলো, কিন্তু মিত্র জোট পারস্পরিক নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল সে সময়। যুদ্ধ পরবর্তীতে বিশ্ব যে কোল্ড ওয়ার এর মুখোমুখি হয়েছিলো, তা মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরই ফলাফল। প্রিয় পাঠক, আপনারা হয়তো স্বীকার করবেন, বর্তমান বিশ্ব সে অবস্থা থেকে আজও মুক্তি পায়নি। 

 

 

তথ্যসূত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/World_War_II

https://www.history.com/topics/world-war-ii/world-war-ii-history

https://www.britannica.com/event/World-War-II

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top