turkey-istanbul-golden-peak.jpg

অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন

অটোমান সাম্রাজ্য। আমরা যে সময়টাকে মধ্যযুগ হিসেবে জেনে এসেছি, সেই সময়কালে গঠিত একটি সাম্রাজ্য ছিল এটি। তৎকালীন সময়ের কয়েকটি তুর্কি উপজাতির ভাঙ্গনের পরে বেশ কিছু ঘটনা প্রবাহের চূড়ান্ত প্রকাশ হিসেবে ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

অটোমান সাম্রাজ্য, মূলত আনাতোলিয়ার (এশিয়া মাইনর) কিছু তুর্কি উপজাতির দ্বারা তৈরি একটি সাম্রাজ্য যা ১৫শ থেকে ১৬শ শতকের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সম্রাজ্য হয়ে উঠেছিল।

অটোম্যানরা তখনকার ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সাম্রাজ্যটি গড়ে তুলেছিল। তুর্কি প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন উত্তরসূরী রাজ্যগুলির দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার মাধ্যমে এটি বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম, এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। তুর্কি, মিশর, গ্রীস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, ম্যাসেডোনিয়া, হাঙ্গেরি, ইস্রায়েল, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, আরব উপদ্বীপ এবং উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশ অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৫৫৯ সালে এর সর্বাধিক আয়তন ছিল ৭.৬ মিলিয়ন বর্গমাইল (১৯.৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার)। ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ছড়িয়ে পড়া এবং বিকশিত হওয়া অটোমান সাম্রাজ্যর জৌলুশ ১৮ শ শতাব্দীতে হ্রাস পেতে শুরু করে। এর প্রধান অংশটি তুরস্ককে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিল।

চলুন এর বিস্তৃত ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে জেনে আসি। 

অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান এবং বৃদ্ধি

 2710788094_85ae47bb0a_b.jpg

তুর্কির সেলজুক সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার সময় ১২০০  শতাব্দীর শেষদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। এই সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার পরে তুর্কির অটোমান জাতি পূর্বের সাম্রাজ্যের অধীন বিভিন্ন রাজ্যগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে এবং ১৪০০ এর দশকের শেষের দিকে অন্যান্য সমস্ত তুর্কি রাজবংশগুলি অটোমান তুর্কিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। 

অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম দিনগুলিতে, নেতাদের মূল লক্ষ্য ছিল সম্রাজ্জ্যের সম্প্রসারণ এবং বৃদ্ধি তরান্বিত করা। অটোম্যানদের সম্প্রসারণের প্রথম দিকে এ সম্রাজ্জ্যের বিস্তার প্রথম ওসমান, অর্খানের অধীনে ঘটেছিল। ১৩০০ শতাব্দীর শেষদিকে, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অটোম্যানদের জন্য আরও নতুন ভুমি  অর্জন করতে সাহায্য করেছিল এবং এর পরপরই তারা ইউরোপে অটোমান সম্রাজ্জ্য সম্প্রসারণের কার্যক্রম শুরু করে।

১৪০০ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কিছু সামরিক পরাজয়ের পরে অটোম্যানরা প্রথম মুহাম্মদ এর মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা ফিরে পায়। ১৪৫৩ সালে তারা কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে। এরপরে অটোমান সাম্রাজ্য তার সাফল্লের চরম উচ্চতায় পৌঁছেছিল এবং ইতিহাসে এ ঘটনাটি মহা সম্প্রসারনের সময়কাল নামে পরিচিত।

এই সময়টিতে অটোম্যান সাম্রাজ্য দশটি বিভিন্ন ইউরোপীয় এবং মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন রাজ্যগুলিকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। বিশ্বাস করা হয় যে, অটোমান সাম্রাজ্য এত দ্রুত বিকাশ লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল কারণ অন্যান্য রাজ্যগুলি তুলনামুলক দুর্বল ও অসংগঠিত ছিল। এ কারণেই অটোম্যানরা সেই সময়ের যুদ্ধের জন্য উন্নত সামরিক সংস্থা এবং কৌশল নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

১৫১৭ সালে মামলুকদের পরাজয়ের সাথে সাথে মিশর ও সিরিয়ায় অটোমান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ অব্যাহত হতে থাকে। ১৫১৮ সালে আলজিয়ার্স এবং ১৫২৬ ও ১৫৪১ সালে হাঙ্গেরি পর্যন্ত তাদের সম্রাজ্যর বিস্তার ঘটেছিলো। এছাড়াও, ১৫০০ শতাব্দীতে গ্রিসের কিছু অংশও অটোমান নিয়ন্ত্রণে আসে। 

১৫৩৫ সালে, সুলায়মান (প্রথম) শাসনামল শুরু হয়েছিল এবং তুরস্ক পূর্বের নেতাদের অধীনে আরও ক্ষমতা অর্জন করেছিল। সুলায়মানের শাসনামলে তুর্কি বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠিত হয় এবং তুর্কি সংস্কৃতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুলায়মান প্রথমের মৃত্যুর পরে, সাম্রাজ্যের শক্তি হারাতে শুরু করে যখন ১৫৭১ সালে লেপান্টো যুদ্ধের সময় অটোম্যানদের সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়। 

অটোমান সাম্রাজ্যের শক্তি হ্রাস এবং পতন

689px-Sultan_Gazi_ʻUthmān_Han_I_-_السُلطان_الغازي_عُثمان_خان_الأوَّل.png March 30, 2020
Sultan Osman

১৫০০ এর বাকী সময়গুলোতে এবং ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে অটোম্যান সাম্রাজ্য বেশ কয়েকটি সামরিক পরাজয়ের সম্মুখিন হয় এবং ক্ষমতা যথেষ্ট হ্রাস পেতে শুরু করে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, পার্সিয়া এবং ভেনিসে সামরিক বিজয়ের পরে সাম্রাজ্য অল্প সময়ের জন্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। ১৬৯৯ সালের পরবর্তীকালে, সাম্রাজ্য আবার বিভিন্ন অঞ্চল এবং ক্ষমতা হারাতে শুরু করে।

১৭০০ এর দশকে, রুশ-তুর্কি যুদ্ধের পরে অটোমান সাম্রাজ্যে দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। সেই সময়ে হওয়া একটি চুক্তির ফলে সাম্রাজ্যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারায়। ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত স্থায়ী ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, অটোম্যান সম্রাজ্জ্যকে আরও  নিঃশেষ করে দিয়েছিল। ১৮৫৬ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা প্যারিসের কংগ্রেস দ্বারা স্বীকৃতি পেয়েছিল, তা সত্ত্বেও ইউরোপীয় শক্তি হিসাবে এটি তার সার্বিক শক্তি হারাতে থাকে।

১৮০০ শতাব্দীর শেষের দিকে, বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ হয়েছিল এবং অটোমান সাম্রাজ্যে বেশ কিছু অঞ্চল হারায়। ১৮৯০ এর দিকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা সাম্রাজ্যের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনেকটা নেতিবাচকতা দৃষ্টিতে দেখাতে শুরু করে। ১৯১২ এবং ১৯১৩ এর বালকান যুদ্ধ এবং তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের অভ্যুত্থান সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডের পরিধিকে আরও হ্রাস করে এবং সেই সাথে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পরে, সেভ্রেস চুক্তির মাধ্যমে সরকারীভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।

ইতিহাসে অটোমান সাম্রাজ্যের গুরুত্ব

পতন সত্ত্বেও অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম, দীর্ঘস্থায়ী এবং সবচেয়ে সফল সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্য কেন  এতটা সফল হয়েছিল তার অনেকগুলি কারণ রয়েছে তবে এর মধ্যে কয়েকটিতে এর অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুসংহত সামরিক এবং এর কেন্দ্রিয় মজবুত রাজনৈতিক কাঠামো অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাথমিক, সফল সরকারগুলি অটোমান সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে গড়ে তুলেছে।

 

 

তথ্যসূত্রঃ- https://www.history.com/topics/middle-east/ottoman-empire

https://www.britannica.com/place/Ottoman-Empire

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top