জার্মান কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প এর তালিকা এবং এর কুখ্যাত ইতিহাস

১৯৩৩ পরবর্তী হলোকাস্টের সময়, নাৎসিরা পুরো ইউরোপ জুড়েই কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। আপনি যদি এ ক্যাম্পগুলির অবস্থান নির্ণয় করতে যান, তবে একটা বিষয় আপনি খুব ভালভাবেই বুঝতে পারবেন যে, পূর্ব ইউরোপ জুড়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনী আসলেই কতটা প্রসারিত হয়েছিল এবং তাদের উপস্থিতি সেখানকার সার্বিক জীবনজাত্রায় কতটা প্রভাব ফেলেছিল।

 

প্রথমদিকে, হিটলারের চিন্তায় ইহুদীরা না থাকলেও, এই কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলিতে রাজনৈতিক বন্দীদের রাখা হতো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই এই ক্যাম্পগুলিতে সাধারন নাগরিকদের বিশেষকরে ইহুদীদের পাঠাতে বাধ্য করা হয়েছিলো, একান্ত বাধ্য হয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হতো।

মূলত বিপুল সংখ্যক অ-রাজনৈতিক বন্দীদের ঘরে পরিণত হয়েছিল এ ক্যাম্পগুলি। অনেক কনসেন্ট্রেশন শিবিরের বন্দিরা ভয়াবহ জীবনযাপন করতো এবং অনেকেই এখানে কাজ করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। 

 

জার্মানির চ্যান্সেলর হিসাবে নিয়োগের দু’মাস পরে হিটলার ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে মিউনিখের কাছে ডাকাউ তে প্রথম কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠিত করে। এ ক্যাম্পটি পরিচালনার জন্য কিছু পদ্ধতি চালু করা হয়, যেগুলো পরবর্তীতে প্রতিটা ক্যাম্পেই বাধ্যতামূলকভাবে জারী করা হয়।

ডাকাউ এর পাশাপাশি বার্লিনের নিকটে ওরেইনবার্গে, হামবুর্গের কাছে এস্টারওয়েজেন এবং স্যাকসনির নিকটে লিচেনবার্গে আরও কিছু ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এমনকি বার্লিন শহরের কলম্বিয়া হাউস ফ্যাশনে, জার্মান গোপন পুলিশের (গেস্টাপো) কাছে অনেকে বন্দী ছিল।

 

১৯৩৪ সালে হিটলারের প্রধান এসএস কমান্ডার হাইনরিখ হিমলারকে শিবিরগুলি একটি বিশেষ পদ্ধতিতে সংগঠিত করার এবং এর সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্রিয় ভাবে তদারকি করার নির্দেশ দেন। এভাবেই মূলত ইহুদি জনগণ এবং নাৎসি সরকারের অন্যান্য অরাজনৈতিক বিরোধীদের ক্যাম্পে রাখার ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।

 

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং জার্মানির আশেপাশের অঞ্চলগুলি দখল করতে শুরু করে। নাৎসি বাহিনীর দ্রুত সম্প্রসারণ এবং দখল দারিত্তের কারনে বন্দীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।

আগত বন্দীদের এই বিশাল জনসংখ্যার কারনে পূর্ব ইউরোপ জুড়ে আরও কসেন্ট্রেশন ক্যাম্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং এ শিবিরগুলি নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত  নাৎসি শাসনামলে ৪০,০০০ এরও বেশি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা অন্যান্য ধরণের বন্দী শিবির স্থাপন করা হয়েছিল।

 

এর মধ্যে পোল্যান্ডের আউশভিটস, নেদারল্যান্ডসের ওয়েস্টারবার্ক, অস্ট্রিয়ায় মাউথাউসেন এবং ইউক্রেনের জানোভস্কা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বন্দী অত্যাচারের দিক থেকে। এছাড়া, ১৯৪১ সালের মধ্যে, নাৎসিরা ইহুদী ও জিপসি উভয়কেই “নির্মূল” করার জন্য চেল্মনো নামে প্রথম বিভৎস এক ক্যাম্প তৈরি করা শুরু করে, যাকে একটি মৃত্যু শিবির নামেও ডাকা হতো।

 

১৯৪২ সালে, আরও তিনটি মৃত্যু শিবির নির্মিত হয়েছিল, এগুলোর নাম যথাক্রমে ট্রেব্লিংকা, সোবিবোর এবং বেলজেক। এ শিবিরগুলি কেবলমাত্র গণহত্যার জন্যই ব্যবহৃত হতো।

হিটলারের নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য সেই সময়ে, অউশভিটস এবং মাজদানেকের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলি হত্যা কেন্দ্র হিসেবে যুক্ত করা হয়েছিল। অনুমান করা হয় যে, নাৎসিরা এই শিবিরগুলি প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার জন্য ব্যবহার করেছিল। নিচে প্রধান প্রধান কয়েকটি কন্সেন্ট্রেশন ও ডেথ ক্যাম্প বিষয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরা হল।

 

আশউইতজ (Auschwitz Concentration and Death Camp)

আশউইতজ (Auschwitz)

কসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা মৃত্যু শিবির উভয় হিসেবে আশউইতজ ছিল বৃহত্তম এবং এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে কার্যকর ধারাবাহিক গণহত্যা কেন্দ্র। এখানে প্রায় ১১ লক্ষ মানুষ খুন হয়েছিল, যার বেশিরভাগ ছিল ইহুদি। আউশউইজ মৃত্যু, হলোকাস্ট এবং ইউরোপীয় ইহুদিদের ধ্বংসের প্রতীক হয়ে উঠেছিলো।

১৯৪০ সালের ২৭ এপ্রিল, হেনরিখ হিমলার পোল্যান্ডের ওসভিয়াসিমের নিকট ক্রাকোর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি নতুন শিবির নির্মাণের নির্দেশ দেন। আশউইতজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প (“অউশভিটস” জার্মান “বানান” ওসভিয়াসিম “) দ্রুত বৃহত্তম কসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা মৃত্যু শিবিরে পরিণত হয়েছিল। 

 

চেল্মন (Chelmno

চেল্মন (Chelmno)

চেল্মন ছিল মূলত একটি মৃত্যু শিবির। এটি পোল্যান্ডের লুরতয মেট্রোপলিটন শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরে একটি গ্রামের কাছে অবস্থিত। ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণের পরে হিটলার পুরো অঞ্চলটিকে “জার্মানাইজেশন” এর লক্ষ্যে রেখসাগা ওয়ার্থল্যান্ডের নতুন এই  অঞ্চলটি সংযুক্ত করে।

গণহত্যার মাধ্যমে জাতিগতভাবে ইহুদীদের নির্মূলকরণের জন্য শিবিরটি বিশেষভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। ঘেটোর পোলিশ ইহুদী জনগোষ্ঠী এবং রেখসাগা ওয়ার্থল্যান্ডের স্থানীয় বাসিন্দাদের সেখানে হত্যা করা হয়েছিল। কমপক্ষে ১,৫২,০০০ মানুষকে এই শিবিরে হত্যা করা হয়। 

এটি সোবিবার, বিয়েক, ট্রেব্লিংকা এবং আউশ্ভিটসের পরে পঞ্চম সবচেয়ে মারাত্মক নির্মূল শিবির হয়ে ওঠে।

 

সোবিবর ডেথ ক্যাম্প (The Sobibor Death Camp

এসএস ওবার্স্টর্মফাহার রিচার্ড থমল্লার (Obersturmführer Richard Thomalla) এর তত্ত্বাবধানে ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে সোবিবর ডেথ ক্যাম্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শিবিরটির অবস্থান, পূর্ব পোল্যান্ডের লুবলিন জেলার সোবিবোর নামক একটি ছোট্ট গ্রামে, এটি সাধারণত অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং এখানে রেলপথের সুবিধা থাকার কারণে স্থানটি বেছে নেওয়া হয়েছিল।

মাত্র ১৮ মাস ধরে পরিচালিত এই মৃত্যু শিবিরে কমপক্ষে ২,৫০,০০০ পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের হত্যা করা হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে মাত্র ৪৮ জন বেঁচে যাওয়া বন্দীকে সোবিবর থেকে উদ্ধার করা হয়। (হলকাস্ট এর মূল নায়ক হেনরিখ হিমলারকে নিয়ে পোষ্টটি এখানে ক্লিক করে পড়তে পারেন)

 

মাজদানেক (The Majdanek Concentration and Death Camp)

মাজদানেক (The Majdanek)

 

ইহুদী নিধনের জন্য অন্যতম প্রধান কুখ্যাত একটি কসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা মৃত্যু শিবির হল মাজদানেক। পোলিশ শহর লুবলিন থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত মাজদানেক কনসেন্ট্রেশন অ্যান্ড ডেথ ক্যাম্পটি ১৯৪১ সালের অক্টোবর থেকে জুলাই ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিল এবং হলোকাস্টের সময় দ্বিতীয় বৃহত্তম নাৎসি কসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিল এটি।

 

এখানে প্রায় ৫,০০,০০০ ইহুদী সহ অন্যান্য বন্দীকে নিয়ে আসা হয়। প্রায় ২,০০০ সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী নিয়ে শুরু করা মজদানেকে আনুমানিক ৩,৬০,০০০ বন্দীকে হত্যা করা হয়েছিল। অন্য শিবির গুলির মতোই মাজদানেকের তিনটি গ্যাস চেম্বারে কার্বন মনোক্সাইড এবং জাইক্লন বি গ্যাস ব্যবহৃত করা হতো বন্দীদের হত্যা করার কাজে।

১৯৪৩ সালের ৩ নভেম্বর একডেশন আর্নেফেষ্টের (গুলি করে মানুষ হত্যা) অংশ হিসাবে মাজদানেকের বাইরে ১৮,০০০ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল, একদিনের জন্য সেটি ছিল একক বৃহত্তম মৃত্যুর সংখ্যা।

 

ট্রেব্লিংকা (Treblinka Concentration and Death Camp)

ট্রেব্লিংকা (Treblinka)

 

অপারেশন রেইনহার্ডের (ইহুদী নিধনের সবচেয়ে মারাত্মক সময়) অংশ হিসাবে ১৯৪২ সালের ২৩ জুলাই থেকে ১৯৪৩ সালের ১৯ অক্টোবর এর মধ্যে ক্যাম্পটি পরিচালিত হয়েছিল। ওয়ারশোর উত্তর-পূর্বে ট্রাবলিংকা ট্রেন স্টেশন থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি জঙ্গলের মধ্যে এ ক্যাম্পটি অবস্থিত। জার্মান এসএস এবং ট্রাভনিকি প্রহরীদের দ্বারা পরিচালিত শিবিরটি দুটি পৃথক ইউনিট নিয়ে গঠিত।

প্রথমটি ছিল একটি শ্রম শিবির যেখানে বন্দীদের জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহের জন্য ব্যাবহার করা হতো। এ কাঠ ব্যাবহার করা হতো মানুষ পোড়ানোর গর্তগুলিকে জ্বালানোর জন্য। এখানে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে, ২০,০০০ এর বেশি বন্দীদের অর্ধেকেরও বেশি সংক্ষিপ্ত মৃত্যুদণ্ড, ক্ষুধা, রোগ এবং নির্যাতনের কারণে মারা গিয়েছিল।

 

দ্বিতীয় ট্রাবলিংকা শিবিরটি হ’ল একটি ডেথ শিবির, যা নাৎসিদের দ্বারা ঐতিহ্যগত ভাবে এসএস-সন্ডারকোমন্ডো(এক প্রকার ইহুদী বন্দী, যারা আগমনের সাথে সাথে নিহত হননি, যাদের অন্যান্য বন্দী হত্যা এবং পোড়ানোর কাজে ব্যাবহার করা হতো, তবে প্রয়োজন শেষে তাদেরও হত্যা করা হয়) ট্রাবলিংকা হিসাবে পরিচিত। 

 

১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সময়ে, অনুমান করা হয় যে, এর গ্যাস চেম্বারে ৭,০০,০০০ থেকে ৯,০০,০০০ ইহুদি নিহত হয়েছিল, এবং ২,০০০ রোমা (যারা জিপসি হিসেবে পরিচিত) নাগরিক। আউশুইটস বাদে অন্য যে কোন নাৎসি নির্বাসন শিবিরের চেয়ে, ট্রেবলিংকায় বেশি ইহুদি মারা গিয়েছিল। 

 

ডাকাউ (Dachau concentration camp)

ডাকাউ (Dachau)

 

নাৎসি ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত ক্যাম্প আশউইতজ, তবে এটিই প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প  ছিল না। প্রথম কনসেন্ট্রেশন শিবিরটি ছিল ডকাউতে, যা ১৯৩৩ সালের ২০ শে মার্চ জার্মানির দক্ষি্নের শহর মিউনিখের উত্তর-পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তৃতীয় রাইখের রাজনৈতিক বন্দীদের বন্দী করার উদ্দেশ্যে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যাদের মধ্যে কেবলমাত্র সংখ্যালঘু ইহুদিদের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি।

 

শুরুতে এটি ছোট পরিসরে থাকলেও নাজি থিওডর আইককের তত্ত্বাবধানে, ডাকাউ একটি মডেল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত হয়েছিল, এটি এমন জায়গায় পরিনত হয়েছিলো যেখানে এসএস প্রহরী এবং অন্যান্য শিবির কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ নিতে যেত। এখানে প্রায় ২,০০,০০০ মানুষকে বন্দিকরে রাখা হয় এবং এর মধ্যে ৫০,০০০ মারা যায়।

 

বেলজেক (Belzec Concentration and Death Camp) 

বেলজেক (Belzec)

 

জার্মান “ফাইনাল সলিউশন” বাস্তবায়ন যা এসএস দ্বারা তৈরি একটি গোপনীয় অপারেশন রেইনহার্ড এর মূল অংশ সমাপ্ত করার জন্য নাৎসি বাহিনী এ ক্যাম্প তৈরি করে। এ স্থানটিকে প্রায়, ৬,০০,০০০ ইহুদী হত্যার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে, এটি একটি নাৎসি জার্মান নির্মূল শিবির ছিল। শিবিরটি ১৯৪২ সালের ১৭ মার্চ থেকে ১৯৪৩ সালের জুনের শেষ পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিল।

তৃতীয় মারাত্মক সর্বনাশা শিবির হিসেবে বেলজেকের কুখ্যাতি রয়েছে, ট্রেব্লিংকা এবং আউশউইটস পরেই এ ক্যাম্পের অবস্থান যেখানে সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। এখানকার সান্দারকোমন্ডোদের মধ্য থেকে কেবল সাত জন ইহুদিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।

 

তথ্যসূত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Nazi_concentration_camps

https://www.throughtco.com

https://www.jewishgen.org/ForgottenCamps/General/ListeEng.html

http://auschwitz.org/en/museum/auschwitz-prisoners/prisoner-numbers

2 thoughts on “জার্মান কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প এর তালিকা এবং এর কুখ্যাত ইতিহাস”

  1. Pingback: হাইনরিখ হিমলার, হলোকাস্ট এর মুল নায়ক এবং এস এস নেতা

  2. Pingback: আউশভিটস কনসেন্ট্রেশন (Auschwitz concentration camp) এবং ডেথ ক্যাম্প - Factsw

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top