arctic circle

আর্কটিক সার্কেল (Arctic circle) কি? আর্কটিক অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থা, জলবায়ু এবং প্রাণী বৈচিত্র্য।

আর্কটিক সার্কেল কি?

আর্কটিক হল উত্তর মেরুতে অবস্থিত পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চল। জুলাই মাসে এখানকার গড় তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি ফরেনহাইট (১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হয়ে থাকে। ভৌগোলিকভাবে, আর্কটিক সার্কেলটি (Arctic circle) আর্টিক মহাসাগর অঞ্চল ঘিরে গড়ে উঠেছে এবং কানাডা, ফিনল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া, সুইডেন এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের (আলাস্কা) অঞ্চলের স্থলভাগ এই আর্কটিক সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত।  

 

আর্কটিকের ভৌগোলিক পরিবেশ ও জলবায়ু 

আর্কটিক সার্কেলের বেশিরভাগ অংশ আর্কটিক মহাসাগর দ্বারা গঠিত যা ইউরেশিয়ান প্লেট হাজার হাজার বছর আগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় তৈরি হয়েছিল। যদিও এই  মহাসাগরটি আর্কটিক অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে নিয়েছে, তথাপি এটি বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রিক অঞ্চল। এখানকার গড় গভীরতা ৩,২০০ ফুট (৯৬৯ মিটার)।

 

আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে বেশ কয়েকটি স্ট্রেইট(সোজা) এবং মৌসুমী জলপথ যেমন উত্তর-পশ্চিম প্যাসেজ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মধ্যে) এবং উত্তর সমুদ্রের রুট (নরওয়ে এবং রাশিয়ার মধ্যে) এর সাথে যুক্ত রয়েছে। 

 

যেহেতু আর্কটিকের বেশিরভাগ অংশটি আর্কটিক মহাসাগর এর সোজাসুজি রয়েছে এবং উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই আর্কটিক অঞ্চলটির বেশিরভাগ অংশ একটি প্রবাহমান বা ভাসমান আইস প্যাকের সমন্বয়ে গঠিত যা শীতের সময় নয় ফুট (তিন মিটার) পুরু হয়ে থাকে। গ্রীষ্মে, এই আইস প্যাক গলে গিয়ে খোলা সাগরে মিশে যায়। বেশিরভাগ ভাসমান আইসবার্গগুলি প্রায়শই স্থল হিমবাহের সাথে মিশে থাকে এবং কোন কোন সময় হিমবাহের মুল অংশ থেকে ভেঙে যায়। 

 

আর্কটিক অঞ্চলের জলবায়ু পৃথিবীর নিরীক্ষীয় কারনে বছরের বেশিরভাগ সময় খুব শীতল থাকে এবং চরম্ভাবাপন্ন থাকে। এ কারণে অঞ্চলটিতে কখনও সরাসরি সূর্যের আলো পরে না, পরিবর্তে পরোক্ষভাবে কিছুটা সূর্যরশ্মি পায় এবং এখানে কম সৌর বিকিরণ হয়। শীতকালে, আর্কটিক অঞ্চলে ২৪ ঘন্টাই অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে কারণ আর্কটিকের অক্ষাংশটি বছরের এই সময়ে সূর্য থেকে সরে যায়। অন্যদিকে, গ্রীষ্মকালে, এ অঞ্চলে ২৪ ঘন্টাই সূর্যের আলো থাকে কারণ পৃথিবী সূর্যের দিকে এ সময় ঝুঁকে যায়। তবে সূর্যের রশ্মি সরাসরি না পড়ায় আর্কটিকের বেশিরভাগ অংশে গ্রীষ্মকালেও আইস প্যাক গুলো সেরকম একটা হালকা হয় না।

 

আর্কটিক অঞ্চলে বছরের বেশিরভাগ সময় তুষার এবং বরফ দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে, এটির উচ্চ আলবেডো বা প্রতিবিম্বও রয়েছে এবং এভাবে মহাকাশে সৌর বিকিরণ প্রতিফলিত হয়। অ্যান্টার্কটিকা থেকে আর্কটিকের তাপমাত্রা তুলনামুলক কম এবং হালকা হয়। আর্টিকের সর্বনিম্ন রেকর্ড তাপমাত্রার কয়েকটি, যা রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে -৫৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট (-৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) রেকর্ড করা হয়েছিল। গ্রীষ্মের গড় আর্কটিক তাপমাত্রা ৫০° ফরেনহাইট (১০° সেলসিয়াস) হয়। যদিও কিছু জায়গায় তাপমাত্রা স্বল্প সময়ের জন্য .৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) এ পৌঁছতে পারে। 

 

আর্টিক অঞ্চলের উদ্ভিদ এবং প্রাণীকূল

arctic circle_wild life
Arctic circle_wild life

 

আর্কটিকের যেমন একটি কঠোর ও চরমভাবাপন্ন জলবায়ু রয়েছে এবং পারমাফ্রস্ট ধারনাটি প্রচলিত তাই এ অঞ্চলটি মূলত গাছপালাবিহীন টুন্ড্রা জাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত। এখানকার কিছু প্রজাতি যেমন লেকেন(শৈবাল দিয়ে গঠিত এক প্রকার ছত্রাক) এবং শ্যাওলা দেখতে পাওয়া যায়। লচেন এবং শ্যাওলার মতো নিম্ন বর্ধমান উদ্ভিদ, সাধারণত এখানে দেখা যায়, কারণ তাদের অগভীর শিকড় রয়েছে এবং এগুলি বাতাসের কারনে তেমন একটা বৃদ্ধি পায় না, তাছাড়া বেশি বাতাসের দ্বারা এগুলো ক্ষতির ঝুঁকি কম থাকে। (আমাদের সাইবেরিয়া নিয়ে একটি আর্টিকেল রয়েছে এখানে ক্লিক করে পড়ে আসতে পারে)

 

আর্টিকের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন রকম আবহাওয়া্র উপস্থিতি বিভিন্ন প্রকার প্রাণীর প্রজাতি তৈরি করতে সাহায্য করেছে। গ্রীষ্মে, আর্কটিক মহাসাগর এবং এর চারপাশের জলপথগুলিতে  বিভিন্ন প্রকার তিমি, সীল এবং নানা রকমের মাছের সমারোহ লক্ষ্য করা যায়। এবং শক্ত জমিতে নেকড়ে, ভালুক, ক্যারিব, রেঞ্জিয়ার এবং বিভিন্ন ধরণের পাখির দেখা মেলে। তবে শীতকালে, এই সকল প্রজাতির বেশিরভাগই দক্ষিণে উষ্ণ জলবায়ুতে চলে আসে। 

 

আর্টিক অঞ্চলের মানুষ

মানুষ হাজার বছর ধরে আর্কটিক সার্কেলে (Arctic circle)  বসবাস করে আসছে। এরা মূলত আদিবাসীদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল, যেমন কানাডার ইনুইট, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার স্যামি এবং রাশিয়ার নানেটস এবং ইয়াকুটস। বর্তমান আধুনিক সমাজেও এই গোত্র গুলোর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।

 

আর্কটিক তার কঠোর জলবায়ু এবং পারমাফ্রস্টের কারণে কৃষিক্ষেত্রের পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত নয়। আর এ কারনে অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, অনেক আগে এখানকার আদিবাসীরা অপর্যাপ্ত শিকার ও বাইরে থেকে সরবরাহকৃত খাদ্য সংগ্রহের মধ্য দিয়ে বেঁচে ছিল। অনেক স্থানে, আজও বেঁচে থাকা গোত্র গুলোর ক্ষেত্রে এ ব্যাবস্থা এখনো প্রচলিত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্মকালে কানাডার ইনুইট উপজাতি শীতের সময় উপকূলে সিল এবং গ্রীষ্মের সময় ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ প্রাণী শিকার করে বেঁচে থাকে।

 

বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যা এবং কঠোর জলবায়ু সত্ত্বেও, আর্কটিক অঞ্চলটি আজ বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর উল্লেখযোগ্য/পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। সুতরাং, এই কারণেই অনেক দেশ আর্কটিক মহাসাগরের এ আঞ্চলটিকে বিভিন্নভাবে দাবী করে থাকে। আর্কটি্কের কয়েকটি প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে পেট্রোলিয়াম, খনিজ এবং মাছ ধরা। অঞ্চলটিতে বর্তমানে পর্যটন খাতও বৃদ্ধি  পেতে শুরু করেছে। 

 

জলবায়ু পরিবর্তন এবং আর্কটিক

Ice_water
Ice_water

 

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, এটি পরিচিত হয়ে উঠেছে যে আর্কটিক অঞ্চলটি জলবায়ু পরিবর্তন এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। অনেক বৈজ্ঞানিক জলবায়ু মডেলও এ বিষয়ে বৃহত্তর পরিমাণের পূর্বাভাস দেয়।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, একটি অতিপরিচিত বিষয় হয়ে উঠেছে যে, আর্কটিক অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য পুরো পৃথিবীই অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক বৈজ্ঞানিক জলবায়ু মডেলে, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আর্কটিকের জলবায়ু উষ্ণতার বিষয়টি যে বৃহত পরিমাণে ক্ষতি ঘটাতে পারে তার একটি পূর্বাভাস দিয়েছে, এর ফলে আলাস্কা এবং গ্রিনল্যান্ডের মতো জায়গার বরফের প্যাকগুলি অতি-মাত্রায় সঙ্কুচিত হবে এবং হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যেতে পারে মর্মে এ সকল মডেলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। 

এটি বিশ্বাস করা হয় যে, আর্কটিক মূলত সৌর প্রতিক্রিয়ার কারণে বেশ সংবেদনশীল এবং উচ্চ সৌর বিকিরণকে প্রতিফলিত করে। তবে সমুদ্রের বরফ এবং হিমবাহগুলি গলে যাওয়ার সাথে সাথে সমুদ্র তা শোষণ শুরু করে। প্রতিবিম্বের পরিবর্তে, সৌর বিকিরণ, তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বেশিরভাগ জলবায়ু মডেলে ২০৪০ সালের মধ্যে, সেপ্টেম্বর মাসে (বছরের উষ্ণতম সময়) সমুদ্রের বরফ সম্পূর্ণ ক্ষতির কাছাকাছি অবস্থায় থাকে, যা আমাদের জন্য খুব একটা ভাল খবর নয়।

 

আর্টিকের বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে পৃথিবীতে বেশ কিছু সমস্যা তাৎক্ষণীক সৃষ্টি হবে। এর মধ্যে রয়েছে অনেক প্রজাতির বাসস্থান হ্রাস পাবে এবং আর্কটিক অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। সমুদ্রের বরফ এবং হিমবাহ গলে গেলে বিশ্বের জন্য সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধি এবং পেরমাফ্রোস্টে সঞ্চিত মিথেন গ্যাস মুক্তি পাবে যা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং এতে সারা পৃথিবীর নিন্ম অঞ্চল প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্থ হবে (বাংলাদেশও কিন্তু এর থেকে রেহাই পাবে না)।

 

আর্কটিক সার্কেলের জলবায়ু, প্রকৃতি, জীব বৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সম্পদ সহ প্রতিটি উপাদানেরই একটি অতি গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা রয়েছে সারা পৃথিবীর সার্বিক পরিবিশের ভারসাম্যর উপর। তাই এটাই সঠিক সময়, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। আমাদের এ বাসস্থানকে সুস্থ রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব? 

 

তথ্যসূত্র – http://www.arctic.noaa.gov/ ওয়েবসাইট এর পেজ এছাড়া

                 https://en.wikipedia.org/  

                 https://www.thoughtco.com/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top