হাইনরিখ হিমলার, হলোকাস্ট এর মুল নায়ক এবং এস এস নেতা

হিটলারকে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের মুল নায়ক বলা হলেও, এমন একজন বাক্তি সে সময় হিটলারের পাশে ছিলেন, যিনি হিটলারের নির্দেশ গুলোকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের শৈল্পিক রুপ দিয়েছিলেন। হেনরিখ হিমলার হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি।

হিটলারের খুনে  নাৎসি পার্টির মূল ব্যাক্তি এবং ইহুদীদের মনে আতংক সৃষ্টি করা এসএস নেতা। প্রচন্ড বর্ণবাদী এবং ইহুদী মতাদর্শকে দু পায়ে দমন করে একটি আশ্চর্যজনক দক্ষ কিলিং মেশিনে পরিণত হয়েছিলেন তিনি সে সময়।

হিটলারের প্রতি হিমলারের কট্টর নিষ্ঠা, পাশাপাশি সিদ্ধিবিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ সে সময় তার নাৎসিবাদী বিশ্বাসকে অনেক বেশি মজবুত করেছিল এবং এ সকল বিষয়গুলো তাকে হলোকাস্টের অন্যতম প্রধান স্থপতি হিসাবে পরিণত করেছিল।

তৃতীয় রাইখের নিয়ন্ত্রণাধীন সেনাবাহিনীর কমান্ডার, হেনরিখ হিমলার হলোকস্টের জন্য সরাসরি অভিযুক্ত ব্যাক্তিদের একজন।

হিমলারের শৈশব এবং প্রথম জীবন

হিমলারের জন্ম ১৯০০ সালের ৭ অক্টোবর, জার্মানির বাভারিয়ার মিউনিখে। তাঁর বাবা গ্যাবার্ড হিমলার ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। ক্যারিয়ারের শুরুতে, হিমলারের বাবা বাভারিয়ার প্রিন্স হেইনরিচের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং রাজকন্যার সম্মানে তিনি তার পুত্রকে হিমলার নামকরণ করেছিলেন।

হিমলার ছিলেন মধ্যবিত্তশ্রেণীর রোমান ক্যাথলিক পরিবারের সন্তান। অতি রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম হয়েছিলো তার। ছোট বেলা থেকেই জীবনাবসান পর্যন্ত নানা রকম শারীরিক সমস্যায় ভুগেছেন তিনি। তা সত্ত্বেও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে সংরক্ষিত ব্যাটলিয়নের সদস্য ছিলেন তিনি ।

যুদ্ধ কালিন সময়ে প্রশিক্ষণ শেষ করতে করতেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং জার্মানির পরাজায় ঘটে। যুদ্ধে যোগদানে অনীহা এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করায় বাটেলিয়ান হতে থকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি তার গ্রামে ফিরে আসেন এবং কৃষিক্ষেত্রে অধ্যয়ন শুরু করেন।

দেখে মনে হয়েছিল যে তিনি একজন খাঁটি কৃষক হতে চলেছেন। তবে অন্যান্য তরুণ ও ক্ষুব্ধ জার্মানদের মতো তিনিও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনে আগ্রহী হয়ে মিত্রশক্তির দ্বারা তার দেশের পরাজয় এবং অনুভূত অপমানের প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছিলো। 

হিমলারের উত্থান

হিমলারের সাথে হিটলার

হিমলার ১৯২৩ সালে নাৎসি পার্টির সদস্য হন এবং ১৯২৫ সালে এস এস বিভাগে যোগ দেন। রোমে হিটলারের এক ব্যার্থ অভুত্থানের পরে হিমলার মূলত নাৎসি পার্টিতে বেশ সক্রিয় হয়ে পরেন এবং হিটলারের অত্যন্ত প্রিয় ব্যাক্তিতে পরিনত হন।

১৯২৯ সালে হিটলার তাকে রাইখফুয়েরার-এসএস এর (শুট্জস্টাফেল, নাৎসি আধা সামরিক সংস্থা) সদস্য  হিসেবে মনোনয়োন দেন। হিটলারের বিভিন্ন জনসমাবেশে তিনি হিটলারের সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন দেহরক্ষী ছিলেন।

এসএস-এর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে, হিমলার নাৎসি পার্টির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা, বিভিন্ন পাওনা আদায় এবং পার্টির প্রচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতেন। সৈন্যদের জন্য কালো রঙের ইউনিফর্ম এর চিন্তা তার মাথায়ই প্রথম এসেছিল, তিনি মনে করতেন কালো ইউনিফর্মে সৈন্যরা হবে নাৎসি মুভমেন্টের ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের নাইট। 

হিমলারের দ্বারা এস এস এর পুনর্গঠন

১৯৩০ এর গোড়ার দিকে হিটলার জার্মানির ক্ষমতা দখলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে হিমলার এসএসের আকার এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি এর বর্ণবাদী চরিত্র তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি এসএসের জন্য একটি বিবাহের কোড জারি করেছিলেন। ব্লুট আনড বোডেন (ইংরেজিতে রক্ত ​​এবং মাটি) ধারণার উপর ভিত্তি করে এসএস সদস্যদের বর্ণগত বিশুদ্ধতার উপর বিশেষ জোর দেয়া হতো।

বিয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি সৈন্যর সম্ভাব্য স্ত্রীদের শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতো। তাদের এটা প্রমান করা বাধ্যতামূলক ছিল যে তারা ইহুদি বা স্লাভিক বংশধর থেকে মুক্ত।

হিমলার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে এক প্রকার মরিয়া হয়ে ওঠেন। ১৯৩২ সালের মধ্যে এই সংস্থাটি ৫০,০০০ এরও বেশি সদস্য সংখায় উন্নীত হয়েছিল। এবং মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে, এসএস ২,০০,০০০ এরও বেশি সদস্যর এক বিশাল বাহিনীতে পরিনত হয়। 

এ সব ছাড়াও হিমলার এস এস নিয়ে বেশকিছু পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং এ সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য রেইনহার্ড হাইড্রিশের ভুমিকাও নেহাত কম নয়। হাইড্রিশের বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি জার্মানির মধ্যে একটি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন।

হিটলার বিরোধীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহনের ক্ষেত্রে এ গুপ্তচর নেটওয়ার্ক বিরাট ভুমিকা পালন করে।

১৯৩৩ সালে হিটলারের ক্ষমতায় আসার পরপরই এটি্র ফলাফল আরও দৃশ্যমান হতে থাকে যখন  হিমলার এবং হাইড্রিশ ডাকাউতে প্রথন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পটি চালু করেন।

এটি নাৎসি সরকারের বিরোধিতা করা প্রত্যেকের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসাবে কাজ করেছিল। মূলত ১৯৩০ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত সময়ে হিমলার এস এস এর ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নাৎসি নেতৃত্বের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

১৯৩০ এর দশকের শেষে নাৎসি পার্টির মধ্যে এসএস প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠেছিল। এবং হিমলার কেবল এসএসের প্রধান হিসাবেই নয়, হিটলারের পরে জার্মানির সর্বাধিক শক্তিশালী ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করেন এবং  প্রতিষ্ঠিত করেন গোপন পুলিশ বাহিনী গেস্টাপো। 

ইহুদী নিধনে হিমলারের ভুমিকা

লক্ষ লক্ষ ইউরোপীয় ইহুদিকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে বধ করার মাধ্যমে হোলোকাস্টে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন। হিমলার শৈশবকাল থেকেই ছিলেন সেমিট বিরোধী কট্টরবাদী, এবং এ বিশয়টিই তাকে ইহুদিদের উপর অত্যাচারের জন্য মহাশক্তি যোগান দিয়েছিলো। ১৯৩৯ সালে জার্মানি যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করে, তখন এসএসের সামরিক বাহিনী ইউনিট আক্রমণ বাহিনীর মুল অংশে ছিল।

হিমলারের নির্দেশে জার্মান সেনার দ্বারা জয় করা অঞ্চলগুলি এসএস বাহিনী্র নিকট হস্তান্তর করা হয়। এবং এর উদ্দেশ্য ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত জনসংখ্যা অপসারণ করা, যার অর্থ সাধারণত ইহুদিদের হত্যা করা। আইনস্টাটগ্রুপেন, নামে পরিচিত এসএস ইউনিটগুলি পোল্যান্ড জুড়ে ইহুদিদের দল বেঁধে হত্যা করেছিল। 

১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ করার সময়, এসএস ইউনিটগুলি ইহুদীদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার পথ অনুসরণ করেছিল। ১৯৪১ সালের শেষের  দিকে এ অঞ্চলে এসএস বাহিনীর দ্বারা বড় আকারের গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নেই ১৩ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করা হয়। 

১৯৪২ সালের জানুরিতে ওয়ানসি সম্মেলনে হাইনড্রিক হিমলার ইউরোপের ইহুদীদের উপর প্রচন্ড আক্রমনের পরিকল্পনা করেন। যা ইতিহাসে “ফাইনাল সলুশন” নামে কুখ্যাতি লাভ করে। এটা ছিল মূলত ইহুদীদের স-মুলে বিনাশ করার একটি মহা-পরিকল্পনা।

যদিও গণহত্যার এই পরিকল্পনা করার কয়েক মাস পরে গুপ্তঘাতকের হাতে হাইনড্রিক নিহত হন। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেমে থাকেনি, ঠিকই একজন সদা প্রস্তুত ছিলেন, তিনি আর কেও না, হেন্রিখ হিমলার। 

১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে  “ফাইনাল সলুশন” বাস্তবায়নের জন্য হিমলার লক্ষ লক্ষ ইহুদীকে  হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত শিবিরগুলিতে কী ঘটছিল তার দিকে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন। সবচেয়ে কুখ্যাত হিসেবে পরিচিত আউশভিটস ডেথ ক্যাম্প একাধিকবার পরিদর্শন করেন তিনি। এখানে নিহত ১১ লক্ষ ইহুদীকে তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হত্যা করা হয়।

কীভাবে ক্যাম্পগুলি চালানো উচিত সে সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে তিনি আদেশ জারি করতেন, এমনকি বন্দীদের কতটা খাদ্য দেওয়া উচিত তাও বিশদভাবে জানিয়ে দিতেন।

নাৎসি চিকিত্সক কর্তৃক পরিচালিত ভয়াবহ চিকিত্সা পরীক্ষাগুলিতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়েছিলেন তিনি। সে পরীক্ষাগুলি যে কতটা ভয়াভহ ছিল তা মিত্র বাহিনীর ক্যাম্পগুলিকে মুক্ত করার সময় বোঝা যায়। 

পূর্ব ইউরোপের নাৎসি প্রচারের অংশ হিসাবে, তার নির্দেশে অনেক ইহুদিদের ঘেটতে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল, যেখানে উপচে পড়া ভিড় এবং পাশবিক পরিস্থিতিতে এ ঘেঁটো গুলো ছিল পরিপূর্ণ। হিমলার ওয়ারশ ঘেটোর ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন এবং ১৯৪৩ সালের বসন্তে ইহুদিরা যখন বিদ্রোহ করেছিল, তখন তিনি সেখানে নৃশংস অভিযান পরিচালনার আদেশ দিয়েছিলেন যা ছিল সেখানকার বাসিন্দাদের পুরোপুরি নির্মূল করা মতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে জার্মানরা পরাজয়ের শিকার হতে শুরু করে, এবং এসময় হিমলারের এসএস গেরিলারা ধ্বংসে আরও বেশি মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।

প্রকৃতপক্ষে, যে সব ঘেঁটো এবং কসেন্ট্রেশন বা ডেথ ক্যাম্প গুলি হিমলার সরাসরি তত্ত্বাবধান করতেন তার প্রত্যেকটাই ছিল এক একটি মৃত্যু কুপ। ইহুদী, সাধারন নাগরিক, জিপসি, সমকামী প্রত্যেকেই নৃশংস তার স্বীকার হয়েছে হিমলারের নির্দেশের দ্বারা।

হিমলারের চুরান্ত পরিনতি

১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে, যখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে জার্মানি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে, তখন হিমলার আমেরিকানদের কাছে শান্তি চুক্তি করার জন্য একটি প্রস্তাব পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি যুদ্ধাপরাধী হিসাবে মামলা থেকে অব্যাহতি পাবার প্রত্যাশা করেছিলেন। ইউরোপে আমেরিকান কমান্ডার জেনারেল ডুইট ডি আইসেনহওয়ার হিমলারের শান্তি প্রস্তাব বিবেচনা করতে অস্বীকার করে এবং তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে ঘোষণা করেন।

হিমলারের এহেন বিশ্বাসঘাতকতায় হিটলার ক্ষুব্ধ হয়ে হিমলারকে তার ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। জার্মানি যখন ভেঙে পড়ছিল, হিমলার পালানোর চেষ্টা করেন। তিনি তার গোঁফ কামিয়েছিলেন, বেসামরিক পোশাকে পরেছিলেন এবং তিনি জাল পরিচয়পত্র তৈরির মাধ্যমে রাস্তায় ভ্রমণকারী শরণার্থীদের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

এমনই অবস্থায় পালানোর সময় হিমলারকে ব্রিটিশ সৈন্যদের দ্বারা পরিচালিত একটি চৌকিতে থামানো হয়। তার জাল পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সেনাদের সন্দেহ হলে, তারা তাকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যান এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেন। প্রশ্ন করা হলে হিমলার তার আসল পরিচয় স্বীকার করে্ন।

১৯৪৫ সালের ২৩ শে মে রাতে তল্লাশী চলাকালীন হিমলার বিষ পানের মাধ্যমে আত্মহত্যা করেন। সেই সাথে একটি কুখ্যাত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

তথ্যসুত্রঃ-  https://en.wikipedia.org/wiki/Heinrich_Himmler

https://www.britannica.com/biography/Heinrich-Himmler

https://encyclopedia.ushmm.org/content/en/article/heinrich-himmler

https://www.thoughtco.com/

3 thoughts on “হাইনরিখ হিমলার, হলোকাস্ট এর মুল নায়ক এবং এস এস নেতা”

  1. Pingback: জার্মান কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প এর তালিকা এবং এর কুখ্যাত ইতিহাস

  2. Pingback: ইহুদী নিধন। ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত।

  3. Pingback: আউশভিটস কনসেন্ট্রেশন (Auschwitz concentration camp) এবং ডেথ ক্যাম্প - Factsw

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top