মুনিবা মাজারি, অনুপ্রেরণার এক নতুন নাম

মুনিবা মাজারি এমন একটি নাম যা থেকে আমরা এমন একটা জীবনের গল্প জানতে পারি, যা শুধু আমাদের অনুপ্রেরণাই যোগায় না, এটি আমাদেরকে নতুন ভাবে ভাবতে শেখায়। মাজারির জীবনের গল্প আমাদের এমন কিছু বলবে যা আপনি কখনই শোনেন নি।

 

এটা এমন কোন  জটিল বা কঠিন বিষয় নয়। মুনিবা মাজারির জীবন থেকে আমরা এ সহজ কথাটাই শিখতে যাচ্ছি। একটা হুইলচেয়ার আর একটা সবল হাত, সাথে একটি ইউনিক ব্রেন, মুনিবা মাজারিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। এ মানুষের জীবনটা একজন প্রতিবন্ধী ব্যাক্তির জীবনের গল্প।

একজন মানুষ হুইলচেয়ার এ বসে পাকিস্তানের মতো একটি রক্ষণশীল দেশ থেকে হয়েছেন শীর্ষ মডেল। এছাড়াও অন্যতম টিভি উপস্থাপক, একজন প্রেরনাদায়ি বক্তা, সংগীত শিল্প, এবং  চিত্রকর্মের প্রতি তার রয়েছে বিশেষ প্রতিভা। মাজারি এটা প্রমান করেছেন, জীবন থেকে যা চলে গিয়েছে সেদিকে না তাকিয়ে যেটা আছে সেটা নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

মুনিবা মাজারি, এমন একটি নাম যাকে প্রতিবন্ধকতা কখনো দমিয়ে রাখতে পারেনি। 

 

মুনিবা মাজারির শৈশব এবং বিবাহিত জীবন

পাকিস্তানের একটি রক্ষণশীল পরিবারে ১৯৮৭ সালের ৩রা মার্চ মুনিবা মাজারি জন্ম গ্রহণ করেন। মাজারি যখন সড়ক  দুর্ঘটনায় আহত হন তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২০ বছর (দিনটি ছিলো ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৭ ) এবং এর মাত্র ২ বছর আগে তার বিয়ে হয়েছিল। হাসপাতালে তিনি যখন ২ মাসের অধিক কাল ভর্তি ছিলেন, তখন নানা রকম  মানুষিক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে তখনকার দিন গুলো তাকে অতিবাহিত করতে হয়েছে।

 

পরবর্তীতে তার কিছু সাক্ষাতকার থেকে সে রকম কিছুই জানা যায়। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি তার বৈবাহিক জীবন এবং দুর্ঘটনার বিষয়ে যে সকল কথা বলেছিলেন তা অনেকটা এরকম ” মাত্র ১৮ বছর বয়সে নিজের অমত থাকা সত্তেও মা বাবার পছন্দের পাত্রের সাথে তার বিয়ে হয়।

বিবাহিত জীবনে তিনি খুব একটা সুখী ছিলেন না। গাড়ি চালানোর সময় তার  স্বামীর কিছু অসাবধানতার ফলে দুর্ঘটনাটা ঘটে। স্বামী গাড়ি থেকে লাফিয়ে নিজেকে রক্ষা করলেও, মাজারি আর নিজেকে রক্ষা করতে পারেন নাই। হাসপাতালে থাকা কালীন প্রতিনিয়ত ডাক্তার এর নিকট থেকে তাকে তার শারিরিক অবস্থা সম্পর্কে শুধু হতাশার কথাই শুনতে হয়েছে। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েন নি।

 

তার খুব শখ ছিলো চিত্রকর হওয়ার, কিন্তু ডাক্তার একদিন এসে বললেন শুনেছি আপনার চিত্রশিল্পী হওয়ার খুব ইচ্ছা কিন্তু আপনি এটা হতে পারবেন না। এর পর অনেক হতাশাজনক কথা তাকে শুনতে হয়েছে, তার মেরুদণ্ডএর অবস্থা এতটাই খারাপ যে তিনি মা হতে পারবেন না।

তিনি হাটতে পারবেন না এমন কথা তাকে প্রায়শই শুনতে হত। তার স্পাইনাল কর্ড এতটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল যে, শুধুমাত্র একটা হাত ছাড়া দেহের নিচের অংশটা পুরই অকেজো হয়ে গিয়েছিল। 

 

নতুনভাবে শুরু করা

এসব অবস্থা তাকে মানুষিকভাবে বিপরজস্থ করে তুলেছিল। এসময় তিনি খুব ভেঙে পড়েন। এমন অবস্থা হয়েছিলো যে জীবনটা তিনি রাখবেন কিনা সেটা নিয়েও তার মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছিল। এখান থেকেই তিনি তার জীবনটাকে নতুনভাবে শুরু করেন। যে হাসপাতালের ডক্টর তাকে বলেছিলেন যে তুমি ছবি আকতে  পারবেনা, সেই হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই তিনি একদিন তার ভাই কে রঙ এবং তুলি এনে দিতে বলেন।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি যে ছবিটি আঁকেন তা ছিলো তার নিজের মৃত্যূর ছবি। পরে তিনি বলেছিলেন এটা যে আমার কি ঔষধ হিসেবে কাজ করেছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছবিটি আকার পর অনেক মানুষ হাস্পাতালে এসে তকে অভিনন্দন জানিয়ে যেত, অনেক প্রশংসা তিনি পেতেন। এ সময় তিনি ভাবতেন “ তোমরা কেউ আমার ভেতরের যন্ত্রনা টুকু দেখতে পাচ্ছ না, যেটা শুধু আমি নিজেই দেখি”।

 

সে অবস্থা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তাকে বেঁচে থাকতে হবে । অন্য কারও জন্য না শুধু নিজের জন্য। নিজেকে একজন পারফেক্ট মানুষ হিসেবে তৈরি করার জন্য তাকে বেঁচে থাকতে হবে। 

 

পরবর্তীতে মাজারির ডিভোর্স হয়ে যায়। 

ডাক্তার তাকে বলেছিলেন তিনি কখনো মা হতে পারবেন না, তাই তিনি একটি দুই বছরের বাচ্চা (ছেলে) কে দত্তক হিসেবে নিয়ে নেন।  

 

একটি সাক্ষাৎকারে তিনি সে সময়ের একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছিলেন  “ হাস্পাতাল থেকে ছাড়া পাবার দুই বছর পর, আমি পাকিস্তানের ছোট্ট একটি শহর থেকে একটি ফোন কল পাই, তারা আমার নাম জিজ্ঞাসা করে বলেছিল আমি মুনিবা মাজারি কিনা এবং আমি কোন ছেলে কে দত্তক নিতে চাই কিনা? সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমি প্রসভ বেদনাটা অনুভব করছি। আমি সাথে সাথে বললাম, হাঁ হাঁ আমি আসছি। আমি এখনি আসছি ওকে নেয়ার জন্য। 

 

বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাজারির অবদান

মুনিবা মাজারি নিজেকে হুইলচেয়ারে মধ্যেই আবদ্ধ করে ফেলেন নি। নিজেকে এটা ভাবান নি যে, তিনি একজন অসম্পূর্ণ মানুষ। এ চিন্তা ভাবনা গুলোই তাকে সামনে পুথ চলতে সাহায্য করেছে। 

এভাবেই তিনি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করেন।

তিনি প্রচুর মডেলিং কেম্পেইং করেছেন। হেয়ারড্রেসিং সেলুনগুলির অন্যতম “ টনি অ্যান্ড গাই চেইন “ এর জন্য প্রথম হুইলচেয়ার-ব্যবহারকারী মডেল তিনি।

পরবর্তীতে তিনি একটি টিভি উপস্থাপক হিসেবে যোগদান করেন। সফলতার সাথে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন। 

বিভিন্ন ফোরাম এবং কনফারেন্সে তিনি “মটিভেশনাল বক্তা” হিসেবে অংশ গ্রহণ করে থাকেন। 

বর্তমানে তিনি ইউএন উইমেন পাকিস্তানের জাতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন এবং বিভিন্ন সম্মেলন ও ফোরামে মোটিভেশনাল স্পিকার হিসাবে অংশ নিয়ে থাকেন।                                             

                                           

২০১৫ সালে বিবিসি’র ১০০ জন সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক মহিলা হিসাবে পরিচিত হওয়া দু’জন পাকিস্তানির  মধ্যে তিনি একজন।

 

এছাড়া তিনি একজন মানবাধিকার কর্মীও। তিনি শিশু দের জন্য কাজ করে থাকেন। 

 

নিজের আত্ম উপলব্ধি থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নিজের কিছু ভেঙ্গে গেলে তা নিজেকেই ঠিক করে নিতে হয়। এমনও তো হতে পারে সুস্থ, স্বাভাবিক একটি দেহ থেকে ভাঙ্গে পড়া একটি মন আপনার জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এটাকে শুধু চিন্তার মধ্যে না রেখে মুনিবা মাজারি তার জীবনের উপর এটা প্রয়োগ করেছেন এবং সফল হয়েছেন। 

 

প্রিয় পাঠক, এখানে মুনিবা মাজারির জীবনালেখ্য আরও দীর্ঘ হতে পারত, কিন্তু ইচ্ছা করেই এটা করা হয়নি, কারন এসব জীবনীগুলো পড়ার থেকে এগুলো আমাদেরকে অনেক বেশি ভাবায়। আর এ ভাবনা থেকেই আমরা নতুন উদ্দ্যোম লাভ করি। হয়তো এ সকল জীবন থেকেই ভাঙাচুরা কিছু জীবন নতুনভাবে জোড়া লাগে।

 

” যখন আপনি কোন কিছুর বিনিময়ে কোন কিছু আশা না করে নিঃস্বার্থ ভাবে কাউকে সাহায্য করেন, ঈশ্বরের কাছে তার অর্থ পরিশোধ করার উপায় আছে এবং ঈশ্বর কখনো ভুলে যান না!”-মুনিব মাজারী।

 

তথ্যসুত্রঃ- https://bn.wikipedia.org/wiki/

https://discoveryourselfm.com/muniba-mazari-an-inspiration/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top