ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, এমন একজন বাক্তি যিনি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ কাজগুলো একটি হুইল চেয়ার এ বসে করেছেন। তো প্রিয় পাঠক, চলুন এ মহান প্রেসিডেন্ট এর জীবনে কিছু আলোকপাত করা যাক।
প্রথম জীবনে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট
ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৮২ সালের ৩০ জানুয়ারী নিউইয়র্ক এ জন্ম গ্রহণ করেন। ছোট বেলা থেকেই ধনী পরিবারে বেড়ে উঠেছেন রুজভেল্ট। তাঁর পিতা, জেমস রুজভেল্ট প্রথম ১৮৫১ সালে হার্ভার্ড আইন স্কুল থেকে স্নাতক পাস করেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ডেমক্রাট সদস্য এবং ছোট থাকতেই তিনি একদিন ফ্রাঙ্কলিন কে White Hous এ প্রেসিডেন্ট grevor cleverand এর সাথে দেখা করিয়ে ছিলেন।
জীবনের প্রথন দিকে তার মা সারার প্রভাব তার উপরে অনেক বেশি ছিল। সারা যেহেতু রুজভেল্ট পরিবারের ছিলেন না তাই তিনি ফ্রাঙ্কলিন কে ডিলান (পদবী) হিসেবেই মনে করতেন এবং এটি ছিল তার পারিবারিক পদবী।
মায়ের পদবী ডিলান এবং বাবার পদবী রুসভেল্ট সমন্বয়ে ফ্রাঙ্কলিন এর নাম হয় “ফ্রাঙ্কলিন ডিলান রুসভেল্ট ” যা সংক্ষেপে পরবর্তীতে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট হিসেবে পরিচিতি পায়।
শৈশবেই অনেক বিদেশ ভ্রমন করার ফলে তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সেই জার্মান, ফরাসি, সহ বেশ কিছু ভাষা শিখে ফেলেন। হার্ভার্ড কলেজে পড়া কালীন সময়ে তিনি সাধারন মানের ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “আমি কলেজে চার বছরের জন্য অর্থনীতি পাঠ্যক্রম নিয়েছি এবং আমার যা কিছু শেখানো হয়েছিল তা ভুল ছিল।
শৈশবেই রুজভেল্ট রাইডিং, শুটিং, সারি, পোলো এবং লন টেনিস খেলতে শিখেছিলেন। এ সময় তিনি গলফ খেলাও শিখেছিলেন।
ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট এর পারিবারিক এবং রাজনৈতিক জীবন
১৯০১ সালে, রুজভেল্টের পঞ্চম কাজিন “ থিওডোর রুজভেল্ট “ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হন। থিওডোরের প্রবল নেতৃত্বের স্টাইল এবং সংস্কারের উদ্যোগ ফ্রাঙ্কলিনের রোল মডেল এবং নায়ক করে তুলেছিল।
১৯০৩ সালে ফ্রাঙ্কলিন তার পঞ্চম কাজিন এলেনা রুসভেল্ট কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তার মায়ের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ১ মার্চ, ১৯০৫ সালে, রুজভেল্ট নিউ ইয়র্ক সিটিতে এলেনা রুসভেল্ট কে বিয়ে করেন।
রুজভেল্ট আইন অনুশীলনের প্রতি কিছুটা আবেগী ছিলেন এবং বন্ধুবান্ধবকে জানিয়েছিলেন যে তিনি শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে প্রবেশের পরিকল্পনা করছেন।
তার চাচাত ভাই, থিওডোরের প্রশংসা সত্ত্বেও, ফ্র্যাঙ্কলিন তাঁর পিতার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাথেই যোগাযোগ রেখেছিলেন। ১৯১০ সালের নির্বাচনের আগে স্থানীয় ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নিউ ইয়র্ক রাজ্য বিধানসভার একটি আসনে প্রার্থী হওয়ার জন্য রুজভেল্টকে মনোনয়ন দেয়। যদিও তখন থিওডর রুসভেল্ট এর প্রভাব অনেক বেশি ছিল।
রুজভেল্ট Assistant Secretary হিসেবে ১৯১৩-১৯১৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকান নেভির দায়িত্তে ছিলেন।
১৯২০ সালে তিনি ভাইছ প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন এবং হেরে যান।
নির্বাচনের পরে, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট নিউ ইয়র্ক সিটিতে ফিরে আসেন,এবং ফিদেলিটি এবং ডিপোজিট কোম্পানির সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুনঃ-নিউ ডিল (New Deal) এবং মহামন্দা পরবর্তী মার্কিন ও বিশ্ব অর্থনীতি
রুজভেল্টের অসুস্থতা এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া
তিনি ১৯২২ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিতে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে সমর্থন তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর ক্যারিয়ার অসুস্থতার কারণে লাইনচ্যুত হয়েছিল। ১৯২১ সালের আগস্টে রুজভেল্ট ক্যাম্পোবেলো দ্বীপে অবকাশ জাপন কালীন সময়ে, অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। তার দেহের বিভিন্ন অর্গানগুলো অকেজ হয়ে পড়ে। স্থায়ীভাবে রুজভেল্ট এর শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ অচল হয়ে পড়ে ।
পোলিও তাকে আঘাত করে এবং পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে ফেলে রেখে যাওয়ার সময় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন উঠতি তারকা ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট।
এসময় যদিও তার মা রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু রুজভেল্ট, তাঁর স্ত্রী, এবং রুজভেল্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং উপদেষ্টা লুই হাও সহ প্রায় সবাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, রুজভেল্ট তার রাজনৈতিক কর্মজীবন অব্যাহত রাখবেন।
রুজভেল্ট বহু লোককে বোঝাতে পেরেছিলেন যে তিনি উন্নতি করছেন, এবং পুনরায় পাবলিক অফিসে প্রার্থী হওয়ার আগেই সুস্থ হয়ে যাবেন।
কঠোরভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করেন, তার মাজায় এবং পায়ে লোহার ধনুর্বন্ধনী পরা অবস্থায় স্বল্প দূরত্বে একা একাই তিনি চলতে শুরু করেন।
ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ভিশন সচেতন একজন মানুষ ছিলেন, তিনি সবাইকে বলতেন, যেন কখনও তাঁর হুইলচেয়ার জনসমক্ষে ব্যবহার না করা হয় এবং প্রেসের সামনে এমন কোনও চিত্র যেন তুলে ধরা না হয় যাতে তার অক্ষমতা প্রকাশ পেতে পারে।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে প্রেসিডেন্ট হবার আগে অথবা প্রেসিডেন্ট থাকা কালীন সময়ে তার একটি বড় ইমেজে পরিনত করেছিল। এ অবস্থায়ও তিনি জন সাধারনের সামনে সোজা হয়ে দাড়ঁাতেন, এবং সাপোর্ট হিসেবে তার ছেলে কে তিনি পাশে রাখতেন।
তিনি এমন একজন ব্যাক্তি ছিলেন যে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্তেও তিনি কখনই তার কাজে এবং তার নীতিতে কোন রকমের দুর্বলতা প্রকাশ করেননি।
১৯২৫ সালে শুরু করে রুজভেল্ট বেশিরভাগ সময় দক্ষিণ আমেরিকাতে কাটিয়েছিলেন, প্রথমে তার হাউজবোট, লারোওকে। হাইড্রোথেরাপির সম্ভাব্য সুবিধাগুলি দ্বারা আগ্রহী হয়ে তিনি ১৯২৬ সালে জর্জিয়ার উর্ম স্প্রিংস-এ একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
পুনর্বাসন কেন্দ্রটি তৈরির জন্য রুজভেল্ট শারীরিক থেরাপিস্টের এক কর্মীকে নিয়োগ করেছিলেন এবং ” মেরিওয়েদার ইন “ কেনার জন্য তাঁর বেশিরভাগ উত্তরাধিকার তিনি ব্যবহার করেছিলেন।
১৯৩৮ সালে, রুজভেল্ট ইনফ্যান্টাইল প্যারালাইসিসের জন্য জাতীয় ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা সে সময়ে উদ্ভাবিত পোলিও ভ্যাকসিনগুলি বিকাশের জন্য বিশেষ ভুমিকা পালন করে।
তিনি ১৯২৮ সালে নিউইয়র্ক এর গভর্নর নির্বাচিত হন এবং ১৯৩২ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৩২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে রুজভেল্ট ক্রমশ জাতীয় রাজনীতির দিকে মনোনিবেশ করেন। এবং নির্বাচিত হয়ে একটি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভঙ্গুর রাষ্ট্রের দায়িত্ত ভার কাধে নেন।
একজন হুইল চেয়ারে চলা মানুষের কাধে দায়িত্ব পড়ে আমেরিকা কে হুইল চেয়ার থেকে টেনে তুলে দার করানোর। পক্ষাঘাতগ্রস্থ অসুস্থতা সত্তেও ব্যক্তিগত জয়ের দ্বারা উত্সাহিত, রুজভেল্ট জাতীয় চেতনাকে পুন একত্রিকরণের জন্য তার অবিচ্ছিন্ন আশাবাদ এবং সক্রিয়তার উপর নির্ভর করেছিলেন।
এটি এমন একটি সময়, যখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রায়শই আশ্রয় কেন্দ্রে প্রেরণ করা হত, অথচ তার কাধে গুরু দায়িত্ব এসে পড়ে।
তিনি প্রচণ্ড “ভাল উত্সাহ” এর দ্বারা তার ভোটারদের মন জয় করেছিলেন, যারা তাকে একবার নয়, চার-চার বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল।
আরও পড়ুনঃ- গ্রেট ডিপ্রেশন (Great Depression): মার্কিন অর্থনীতি সহ সারা বিশ্বে যার ঢেউ আছড়ে পড়েছিলো
নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং জীবনাবসান
১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে তাঁর বিখ্যাত ফ্রি ফ্রিডমস ভাষণের মাধ্যমে রুজভেল্ট বিশ্বজুড়ে মৌলিক অধিকারের জন্য মিত্র যুদ্ধের বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলেন।
তার দ্বিতীয় মেয়াদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং আমেরিকা যুদ্ধে যোগদানের পর, রুজভেল্ট সমস্ত বড় কূটনৈতিক এবং সামরিক সিদ্ধান্তে নিবিড়ভাবে ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন। তাঁর জেনারেল এবং অ্যাডমিরালদের সাথে, ব্রিটিশদের যুদ্ধ ও নৌবাহিনী বিভাগ এবং এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন।
১৯৪৫ সালের ২৯ শে মার্চ, রুজভেল্ট জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সম্মেলনে প্রত্যাশিত উপস্থিতির আগে বিশ্রাম নিতে জর্জিয়ার উষ্ণ স্প্রিংসে লিটল হোয়াইট হাউসে অবকাশ যাপনের জন্য যান।
১২ এপ্রিল বিকেলে রুজভেল্ট বলেছিলেন, “আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে।” তার পরে তিনি চেয়ারের দিকে এগিয়ে যান এবং অজ্ঞান হয়ে পরেন।
সেদিন বিকাল ৩:৩৫ মিনিটে , ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ৬৩ বছর বয়সে মারা যান।
রুজভেল্টকে অনেক আফ্রিকান আমেরিকান, ক্যাথলিক এবং ইহুদিরা নায়ক হিসাবে দেখতেন এবং তিনি এই নতুন ভোটার জোটে এই ভোটারদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে আকৃষ্ট করতে অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন। তিনি চীনা-আমেরিকান এবং ফিলিপিনো-আমেরিকানদের কাছ থেকে শক্তিশালী সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রুজভেল্টকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়, পাশাপাশি তাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বর অধিকারি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা ধারাবাহিকভাবে রুজভেল্ট, জর্জ ওয়াশিংটন এবং আব্রাহাম লিংকনকে তিনটি সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতির পদে স্থান দিয়েছেন।
রুজভেল্টের রাষ্ট্রপতিত্বের প্রতিফলন এর ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে ” মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে এসেছিলেন ।
২০০৭ সালে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট (এফডিআর) এর জীবনী লেখক জন এডওয়ার্ড স্মিথ বলেছিলেন, “তিনি জাতিকে হাঁটু থেকে উঠানোর জন্য হুইলচেয়ার থেকে নিজেকে তুলেছিলেন।
এ মহান বাক্তিটির জীবনাবসানের সাথে সাথে তার অর্জন গুলো আরও বেশি জনসম্মুখে প্রকাশ পায়। আমেরিকার ইতিহাসে প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন।
তথ্যসূত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Franklin_D._Roosevelt https://www.history.com/topics/us-presidents/franklin-d-roosevelt https://www.britannica.com/biography/Franklin-D-Roosevelt