১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথম জাপানি বোমা পার্ল হারবার (Pearl Harbor) এর উপরে বর্ষণ হওয়ার পরে, জাপান ও আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছিলো এবং এর ফলে বিগত এক দশক ধরে চলমান আলোচনা ভেস্তে যায়। মূলত এ সময়ই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধকে এক প্রকার অনিবার্য বলেই মনে হয়েছিল।
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর সকালে জাপানি বোমারু বিমানগুলি পার্ল হারবারের উপরে আকাশে উপস্থিত হয়েছিল। এ সময় পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন সেনাবাহিনী জাপানের বিধ্বংসী এবং আশ্চর্য এ আক্রমণটির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। নাটকীয়ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় বিশেষত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে পুরোপুরি অস্থিতিশিল এবং পরিবর্তিত করে ফেলেছিল পার্ল হারবারের আক্রমণ।
তবে এ ধরণের জাপানি আগ্রাসনের বেশ কয়েকটি মূল কারণ ছিল, যা অনিশ্চিতভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে এ ধরণের আক্রমণকে প্রায় অনিবার্য করে তুলেছিল। জাপান কেন এতো আগ্রাসী হয়ে উঠেছিলো আমেরিকার প্রতি? চলুন এ বিষয়টিই খোঁজার চেস্টা করি।
উত্তেজনা শুরু হয়েছিল মহামন্দনের সময়
পার্ল হারবার (Pearl Harbor) এ হামলার আগে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বেড়ে চলেছিল।
দ্বীপ দেশ জাপান, তার ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ের জন্য বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে, এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আগ্রাসী ভূমিকায় এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছিল। ১৮৯৪-৯৫ সালে চীনের বিরুদ্ধে দুটি সফল যুদ্ধ এবং ১৯০৪-০৫ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধ, জাপানের এ ধরণের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করে তোলে। এছাড়া মিত্রদের পাশাপাশি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) জাপানের অংশগ্রহণ ছিল সফল।
১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার (Great Depression) সময়, জাপান এক প্রকার জোর করে চীনে আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করে এবং তাদের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যা সংক্রান্ত সমস্যাগুলি সমাধান করার চেষ্টা করে। ১৯৩১ সালে মনচুরিয়ার আক্রমণ দিয়ে শুরু হয়েছিল, চীনের বিরুদ্ধে এ আগ্রাসন।
লীগ অফ নেশনস (League of Nations) কর্তৃক নিযুক্ত কমিশন যখন এই আক্রমণটির নিন্দা জানায়, তখন জাপান আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে আসে। উল্লেখ্য যে, জাপান ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মনচুরিয়া দখল বজায় রেখেছিল।
১৯৩৭ সালের জুলাইয়ে, বেইজিংয়ের মার্কো পোলো ব্রিজের সংঘর্ষের ফলে আরেকটি চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। সে বছরের ডিসেম্বরে, জাপানি বাহিনী চীনা জাতীয়তাবাদী দল বা গুওমিন্দাং (কুওমিনতাং) (Guomindang (Kuomintang)) এর রাজধানী নানজিং (নানকিং) দখল করার পরে তারা ছয় সপ্তাহে ব্যাপি গণহত্যা ও ধর্ষণ চালিয়ে যায়, যা ইতিহাসে নানজিং গণহত্যা হিসাবে কুখ্যাত।
আরও পড়ুনঃ- এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানি আগ্রাসন সে সময় যেমন ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র জাপানের গ্লোবাল সম্প্রসারণ বন্ধ করার চেষ্টা করছিল
চীনের বিরুদ্ধে এই ধরনের নৃশংসতার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে বিমান রফতানি, তেল ও স্ক্র্যাপ ধাতুর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য অনেক সামগ্রীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। সেই সাথে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন শুরু করে এবং চীনের গুওমিন্দাং বাহিনীকে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়।
১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরে জাপান মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে দুই ফ্যাসিবাদী সরকার জার্মানি এবং ইতালির সাথে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে।
পার্ল হারবার (Pearl Harbor) আক্রমণের আগে, বেশ কয়েক মাস ধরে টোকিও এবং ওয়াশিংটন এর মধ্যে একটি আলোচনা চলেছিল, কিন্তু এ আলোচনা শেষ হয়, কোনও সাফলতা ছাড়াই। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল যে তেল এবং অন্যান্য মূল সামগ্রীর উপর নিষেধাজ্ঞা জাপানকে তার সম্প্রসারণবাদকে থামিয়ে দেবে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য বিষয়গুলো আসলে জাপানকে তার অবস্থানে স্থির রাখতে সাহায্য করেছিল এবং এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিতে অব্যাহত পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জাপান তার জনগণের ক্রোধকে বাড়িয়ে তুলছিল।
জাপান একটি বড় বিশ্বশক্তি হিসাবে নিজেদের অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধকে অপরিহার্য করে তোলে। জাপান এ সময় মনে করেছিল পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন সেনা বেস ধ্বংস করার অর্থ প্রশান্ত মহাসাগরিয় অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে।
১৯৪০ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্যাসিফিক ফ্লিটের, মূল সেনা ঘাঁটি পার্ল হারবারে স্থাপন করে। আমেরিকানরা জাপানিদের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৪,০০০ মাইল দূরে হাওয়াইয়ে জাপানিদের আক্রমণ একেবারেই আশা করেনি, তাই পার্ল হারবারের ঘাঁটি তুলনামূলকভাবে অপরিবর্তিত ছিল। মার্কিনীদের এ ধরণের উদাসীনতা জাপানীদের কাছে পার্ল হারবার একটি সহজ লক্ষ্য হিসাবে পরিণত হয়েছিল।
অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটো ইসোরোকু একটি আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন। যার লক্ষ্য ছিল আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিমান ঘাঁটিটি ধ্বংস করা এবং মার্কিন নৌবাহিনীর মনোবলকে ভেঙে দেয়া। জাপানি বাহিনী দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে লক্ষ্যবস্তুর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপানী ইম্পেরিয়াল বাহিনী সকাল ৮ টার কিছু আগে পার্ল হারবার (Pearl Harbor) এ হামলা চালায়। শেষ পর্যন্ত অনেক প্রান বিসর্জন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে।
তথ্যসূত্রঃ- https://www.history.com/news/why-did-japan-attack-pearl-harbor
https://www.historyonthenet.com/why-did-japan-attack-pearl-harbor
https://www.britannica.com/event/Pearl-Harbor-attack/The-attack