2016_Amatrice_earthquake-min.jpg

পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভুমিকম্প প্রবন এলাকা/অঞ্চল

ভূমিকম্পকে সব সময়ই  প্রাকৃতিকভাবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে একটি নিরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রতিনয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন টেকটনিক প্লেটগুলি তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। হয়তো সেটা ধীরে, কিন্তু এটা সারাক্ষণই ঘটে চলেছে। এ বিষয়টি মানব জাতির কাছে সবসময়ই একটি উদ্বেগের কারন ছিল।

জাতিসংঘ এটাকে সর্বচ্চ গুরুত্ত প্রদান করে “গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামটি (The Global Seismic Hazard Program)” চালু করে। এটি জাতিসংঘের একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প ছিল। এ প্রকল্পের কাজ ছিল পৃথিবীর ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলির ধারাবাহিক একটি মানচিত্র তৈরি করা। 

প্রকল্পটি বিভিন্ন দেশকে ভবিষ্যতের ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত করতে এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি প্রশমিত করতে সাহায্য করে থাকে। এছাড়া ভুমিকম্পে মৃত্যু হ্রাস করার পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করার জন্য এটি ডিজাইন করা হয়েছিল।

বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করে পৃথিবীকে  ২০ টি অঞ্চলে ভাগ করেছিলেন। এটা মূলত বিভিন্ন প্রকার গবেষণা এবং অতীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ভূমিকম্পগুলির রেকর্ড এর ভিত্তিতে করা হয়েছিল।

১৯৯৯ সালে এ প্রকল্পটি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এর ফলে যে মানচিত্র টি সকলের সামনে আসে এবং এর থেকে যে ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হয় তা থেকে ভবিষ্যতের ভুমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলি সম্পর্কে আমাদেরকে একটি সঠিক ধারণা প্রদান করে। প্রতিটা মহাদেশের সম্পূর্ণ অঞ্চলেই এ প্রকল্প তার কার্যক্রম চলিয়েছিল। নিচে ভুমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলি সম্পর্কে একটি চিত্র তুলে ধরা হল।

এশিয়ার ভুমিকম্প প্রবন এলাকা

Asia_laea_relief_location_map
Asia_location_map

গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামটি ভুমিকম্প সম্পর্কিত বেশকিছু বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন আমাদের সামনে প্রকাশ করেছিল। প্রগ্রামটি এশিয়ার উপর একটি জরীপ চালায়। এশিয়ায় ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপ বেশ ভয়াবহ বলা হয়, বিশেষ করে যেখানে অস্ট্রেলিয়ান প্লেটটি ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের চারপাশে জড়িয়ে রয়েছে এবং জাপানেও এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। এ প্লেটটি তিনটি মহাদেশীয় প্লেটকে আঁকড়ে থাকায় ভুমিকম্প ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। 

পৃথিবীতে অন্য কোনও জায়গার চেয়ে জাপানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়া, ফিজি এবং টঙ্গার মতো দেশগুলোতে প্রতিবছর রেকর্ড সংখ্যক ভূমিকম্প অনুভব হয়। ২০১৪ সালে সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে যখন ৯.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন এটি রেকর্ড সৃষ্টি করে এবং ইতিহাসের বৃহত্তম সুনামি তৈরি করেছিল। এর ফলে প্রায় ২,০০,০০০ এরও বেশি মানুষ মারা যায়।

এছাড়াও, অন্যান্য বড় কয়েকটি ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের মধ্যে রয়েছে ১৯৫২ সালে রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপে অনুভুত হওয়া একটি ৯.০ মাত্রার ভূমিকম্প এবং ১৯৫০ সালে তিব্বতে ৮.৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প। নরওয়েতেও এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিলো। 

মধ্য এশিয়া পৃথিবীর অন্যতম বড় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল। এর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ইরানের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণসাগরের পূর্ব তীর থেকে শুরু করে ক্যাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে বিস্তৃত রয়েছে । 

উত্তর আমেরিকার ভুমিকম্প প্রবন এলাকা

গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম তার ডাটাবেজে উত্তর আমেরিকাতে বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্প অঞ্চলের কথা উল্লেখ করেছে। এতে আলাস্কার কেন্দ্রীয় উপকূল থেকে উত্তর দিকে অ্যাংরেজ এবং ফেয়ারব্যাঙ্কস পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেছে ।

১৯৬৪ সালে, আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্প, যা রিখটার স্কেলে ৯.২ পরিমাপ করা হয়। এটি আলাস্কার যুবরাজ উইলিয়াম সাউন্ড এ আঘাত হানে। 

ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে বাজা ক্যালিফোর্নিয়া উপদ্বীপের পাশ দিয়ে আরও একটি সক্রিয় বিস্তৃত এলাকা রয়েছে, যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট, উত্তর আমেরিকার প্লেটের বিপরীতে ঘেসে রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ভ্যালি, সান ফ্রান্সিসকো বে এলাকা, এবং দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বেশিরভাগ অংশে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি বিদ্যমান এবং এগুলো ফ্রান্সিসকোকে সমতল ভুমিতে রুপান্তর করার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় আঘাত হানতে সক্ষম।

মেক্সিকোয়, একটি সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল রয়েছে। পশ্চিম সিয়েরাসের দক্ষিণে পুয়ের্তা ভাল্লার্তার কাছাকাছি থেকে শুরু হয়ে গুয়াতেমালা সীমান্তের দিকে প্রশান্ত মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত চলে গেছে।

আসলে, মধ্য আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের বেশিরভাগ অংশই ভূমিকম্পের দিক থেকে বেশ সক্রিয়। কারণ কোকোস প্লেট ক্যারিবিয়ান প্লেটের বিপরীতে ঘেসে রয়েছে। এছাড়া উত্তর আমেরিকার পূর্ব প্রান্ত তথা কানাডার সেন্ট লরেন্স নদীর প্রবেশপথের কাছে কিছু কিছু ছোট্ট ঝাঁকুনি প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। 

দক্ষিণ আমেরিকার ভুমিকম্প প্রবন এলাকা

দক্ষিণ আমেরিকার সর্বাধিক সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলি মহাদেশের প্রশান্ত মহাসাগরের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। কলম্বিয়া এবং ভেনিজুয়েলার ক্যারিবিয়ান উপকূল বরাবর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল রয়েছে।

দক্ষিণ আমেরিকান প্লেটের সাথে বেশ কয়েকটি মহাদেশীয় প্লেটের সংঘর্ষের কারণে এখানে মাঝে মাঝেই বড় ধরণের শক্তিশালী ভুমিকম্প সংঘটিত হয়। এ পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে দশটি বড় ভূমিকম্পের মধ্যে চারটিই হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়। 

সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬০ সালের মে মাসে। সে সময় মধ্য চিলির, সালভেদরের কাছে ৯.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পের আঘতে ২০ লক্ষরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং প্রায় ৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।

এর অর্ধ শতাব্দী পরে, ২০১০ সালে কনসেপসিওন শহরের কাছে আবার একটি ৮.৮ মাত্রার ভুমিকম্প আঘাত করে। এ আঘাতে প্রায় ৫০০ লোক মারা গিয়েছিল এবং ৮০০,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল এবং নিকটস্থ চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতেও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। এছাড়া পেরুতেও ভূমিকম্প আঘাতের ইতিহাস ট্র্যাজেডির।

ইউরোপের ভুমিকম্প প্রবন এলাকা

গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম তার গবেষণায় উত্তর ইউরোপের পশ্চিম আইসল্যান্ডের আশেপাশের অঞ্চল বাদে ইউরোপের অন্যান্য অংশে আগ্নেয়গিরির ক্রিয়াকলাপ তুলনামুলক কম থাকায় ভূমিকম্পের কিছুটা কম রয়েছে। আবার দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক এবং ভূমধ্যসাগর উপকূলের কিছু অংশ  ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ায়।

আফ্রিকান মহাদেশীয় প্লেট অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের নীচে ইউরেশিয়ান প্লেটকে উপরের দিকে ঠেলে দেয় বলে এখানে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। পর্তুগিজ রাজধানী লিসবোনকে প্রায় ১৯৫৫ সালে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পর দ্বারা কার্যত সমতল করে দেয়া হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত অন্যতম শক্তিশালী রেকর্ড কৃত ভুমিকম্প। মধ্য ইতালি এবং পশ্চিম তুরস্কও ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রস্থল।

আফ্রিকার ভুমিকম্প প্রবন এলাকা

Peak_Ground_Acceleration_and_Seismic_Zoning_map_of_Eritrea-min.jpg

গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম আফ্রিকাতে অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলি তুলনামুলক কম হিসেবে উল্লেখ করেছে। মহাদেশের সাহারা এবং কেন্দ্রীয় অংশ জুড়ে ভূমিকম্পের তেমন কোনও তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় না।

লেবানন সহ পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলজুড়ে কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও সেটা আহামরি কিছু নয়। সেখানে আরবীয় প্লেট ইউরেশিয়ান এবং আফ্রিকান প্লেটের সাথে সংঘর্ষের ফলে এরকমটা হয় বলে ধারণা করা হয়।

হর্ন অফ আফ্রিকার নিকটবর্তী অঞ্চলটি একটি ভুমিকম্প সক্রিয় অঞ্চল। আফ্রিকার তানজানিয়ায় ১৯১০ সালের ডিসেম্বরে ঘটে যাওয়া ৭.৮ মাত্রার ভুমিকম্পটি ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পন হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এর ভুমিকম্প প্রবন এলাকা

গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলোর উপর বিস্তর একটি গবেষণা করেছিল। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে সামগ্রিকভাবে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম থাকলেও এর ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম ।

নিউজিল্যান্ডে সবচেয়ে শক্তিশালী ভুমিকম্পটি আঘাত হানে ১৮৫৫ সালে।

এন্টার্কটিকার ভুমিকম্প প্রবন এলাকা

অন্যান্য ছয়টি মহাদেশের তুলনায় অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম সক্রিয়। অ্যান্টার্কটিকার বৃহত্তম ভূমিকম্প ৮.১ মাত্রার ছিল। এই ঘটনাটি ১৯৯৮ সালে নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণে অবস্থিত ব্যালেনি দ্বীপপুঞ্জে ঘটে।

 

তথ্যসূত্রঃ- https://www.annalsofgeophysics.eu/index.php/annals/article/view/3784

https://www.researchgate.net/publication/27772427_The_Global_Seismic_Hazard_Assessment_Program_GSHAP-19921999

The Global Seismic Hazard Assessment Program (GSHAP)-1992/1999

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top