স্বস্তিকা (swastika) একটি অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতীক। নাৎসিরা এটি হলোকাস্টের সময় কয়েক মিলিয়ন লোককে হত্যার জন্য ব্যবহার করেছিল, তবে বহু শতাব্দী ধরে এটির একটি ইতিবাচক অর্থ বিরাজমান ছিল। স্বস্তিকার ইতিহাস কী? এটি ভাল বা মন্দের প্রতিনিধিত্ব করে কি না? সে বিশয়টিই আজ আমদের আলোচনার বিষয়।
প্রাচীনতম পরিচিত প্রতীক (swastika)
স্বস্তিকা (swastika) একটি প্রাচীন প্রতীক যা ৩,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। (এটি এমনকি প্রাচীন মিশরীরেরও প্রতীক ছিল, যাকে the Ankh! বলা হতো) প্রাচীন ট্রয়ের বিভিন্ন মৃৎশিল্প এবং মুদ্রার মতো বেশ কয়েকটি নিদর্শনে স্বস্তিকা প্রতীক ব্যাবহার করা হয়েছিল, যা প্রমান করে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর পূর্বেও এ প্রতিকের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল।
এর পরবর্তী হাজার বছরের মধ্যে, স্বস্তিকা (swastika) চিহ্নটি চীন, জাপান, ভারত এবং দক্ষিণ ইউরোপ সহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে যে ব্যবহার হয়েছিল তার প্রমান রয়েছে। মধ্যযুগে স্বস্তিকা একটি সুপরিচিত প্রতিক ছিল, তবে সাধারণভাবে এটি বহুল ব্যবহৃত না হলেও বিভিন্ন সময়ে একে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হতো।
চীনে স্বস্তিকাকে ওয়ান (wan) নামে, ইংল্যান্ডে ফাইলফট (fylfot), জার্মানিতে – হাকেনক্রিজ (Hakenkreuz),গ্রীসে – টেট্র্যাস্কেলিয়ন এবং গ্যামাদিয়ন (tetraskelion and gammadion), ভারতে এ প্রতীকটিকে স্বস্তিকা (swastika) নামে ডাকা হতো।
স্থানীয় আমেরিকানরাও দীর্ঘদিন ধরে স্বস্তিকা (swastika) প্রতীক ব্যবহার করেছেন। তবে প্রকৃতপক্ষে এ প্রতীকের ব্যাবহার কখন থেকে শুরু হয়েছিল সেটা বিস্তর গবেষণার বিষয়।
স্বস্তিকার” (swastika) আসল অর্থ

“স্বস্তিকা” (swastika) শব্দটি সংস্কৃত সুভাস্তিকা (svastika) থেকে এসেছে: “সু” অর্থ “ভাল,” “অস্তি” অর্থ “হওয়া”, এবং “কা” প্রত্যয় হিসাবে ব্যাবহার হয়েছে।
নাৎসিরা এই প্রতীকটির ব্যবহার শুরু না করা অবধি স্বস্তিককে বহু সংস্কৃতি গোষ্ঠী গত ৩,০০০ বছর ধরে জীবন, সূর্য, শক্তি, এবং সৌভাগ্যের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
এমনকি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, স্বস্তিকা (swastika) ইতিবাচক অভিব্যক্তির একটি প্রতীক ছিল। বিভিন্ন মাধ্যমে স্বস্তিকা একটি সাধারণ শোভা বর্ধনের জন্য ব্যাবহার হয়ে এসেছে। একটু লক্ষ করলে দেখবেন এ প্রতীকটি প্রায়শই সিগারেটের কেস, পোস্টকার্ড, মুদ্রা এবং বিল্ডিংয়ের গায়ে শোভা পায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, স্বস্তিকা আমেরিকান সেনাবাহিনীর ৪৫ তম বিভাগের কাঁধের ব্যাজে ব্যাবহার করা হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় পর্যন্ত ফিনল্যান্ডের বিমান বাহিনীর এটি ব্যাবহার করেছিল।
স্বস্তিকার” (swastika) অর্থ পরিবর্তন
১৮০০ শতকের দিকে, জার্মানির আশেপাশের দেশগুলির আকার অনেক বড় হয়ে উঠছিল, এরা একটি সাম্রাজ্যের মতো হয়ে উঠেছিলো; তবুও জার্মানি ১৮৭১ সাল পর্যন্ত কোন একীভূত দেশ ছিল না। সামাজিক দুর্বলতা এবং তারুণ্যের কলঙ্কের ইতিহাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জার্মান জাতীয়তাবাদীরা স্বস্তিকা (swastika)ব্যবহার শুরু করে।
উনিশ শতকের শেষের দিকে, স্বস্তিকার বিবরন জাতীয়তাবাদী জার্মান ভলকিশ্চ সাময়িকীতে পাওয়া যেত এবং এটি জার্মান জিমনেস্টস লীগের আনুষ্ঠানিক প্রতীক ছিল।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, স্বস্তিকা জার্মান জাতীয়তাবাদের একটি সাধারণ প্রতীক এবং জার্মান যুব আন্দোলনের ওয়ান্ডারভোগেলের প্রতীক হিসাবে জায়গা করে নেয়।
হিটলার এবং নাৎসি
১৯২০ সালে, অ্যাডল্ফ হিটলার সিদ্ধান্ত নেয় যে নাৎসি পার্টির নিজস্ব পরিচয়ের একটি চিন্নহ এবং পতাকা থাকা দরকার। ১৯২০ সালের ৭ আগস্ট, সালজবার্গ কংগ্রেসে, একটি সাদা বৃত্ত এবং কালো স্বস্তিকা সহ লাল পতাকাটি নাৎসি পার্টির আনুষ্ঠানিক প্রতীক হয়ে ওঠে।
মাইন কাম্পে (হিটলারের আত্মজীবনী), হিটলার নাৎসিদের নতুন পতাকাটির বর্ণনা দিয়েছিলেন: “লাল রঙে আমরা আন্দোলনের সামাজিক ধারণাটি দেখি, সাদা রঙে জাতীয়তাবাদী ধারণাটি প্রকাশ করা হয়, স্বস্তিকাতে আর্য ব্যক্তির বিজয়ের সংগ্রামের মিশন প্রতিফলিত হয়েছে।
নাৎসিদের পতাকার কারণে স্বস্তিকা শীঘ্রই ঘৃণা, বিরোধীতা, সহিংসতা, মৃত্যু এবং হত্যার প্রতীক হয়ে উঠে।
স্বস্তিকা অর্থ এখন কী?

স্বস্তিকার (swastika) এখন কী অর্থ তা নিয়ে দারুণ বিতর্ক রয়েছে। ৩,০০০ বছর ধরে স্বস্তিকা মানে জীবন এবং সৌভাগ্য বোঝাতো। তবে নাৎসিদের কারণে এটি মৃত্যু ও ঘৃণার প্রতিক হয়ে উঠেছে।
এই বিবাদমান অর্থ আজকের সমাজে নানা মুখি সমস্যা সৃষ্টি করছে। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের কাছে স্বস্তিকা একটি অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় প্রতীক যা সাধারণত ব্যবহৃত হয়।
চিরাগ বদলানী তাঁর গল্পে একটি বিষয় শেয়ার করেছেন যখন তিনি তাঁর মন্দিরের জন্য কয়েকটি হিন্দু দেবতার ফটোকপি তৈরি করতে গিয়েছিলেন। ফটোকপিগুলি প্রদানের জন্য লাইনে দাঁড়ানোর সময়, তার পিছনে কিছু লোক লক্ষ্য করলেন যে ছবিগুলির একটিতে স্বস্তিকা রয়েছে। তারা তাকে নাৎসি বলে অভিহিত করেছিল।
দুর্ভাগ্যক্রমে, নাৎসিরা তাদের স্বস্তিকা (swastika) প্রতীক ব্যবহারে এতটাই কার্যকর ছিলেন যে, অনেকেই স্বস্তিকার জন্য ঘৃণা ছাড়া অন্য কোনও অর্থ বুঝেন না। কিন্তু প্রশ্ন হোল, একটি চিহ্নের জন্য দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ কি হতে পারে?
স্বস্তিকা (swastika) বিষয়টির দিকনির্দেশনা কী?
প্রাচীন কালে, স্বস্তিকার (swastika) বিষয়টি একপ্রকার বিনিময়যোগ্য ছিল, যেমন একটি প্রাচীন চীনা সিল্ক অঙ্কনে এটি দেখতে পাওয়া যায়।
অতীতে কিছু সংস্কৃতি ঘড়ির কাঁটাওয়ালা স্বস্তিকা এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে থাকা সৌভাস্তিকের মধ্যে পার্থক্য করেছিল। এই সংস্কৃতিগুলিতে, স্বস্তিকা স্বাস্থ্য ও জীবনের প্রতীক হিসাবে এবং সৌস্টিকরা দুর্ভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের এক রহস্যময় অর্থ গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু নাৎসিদের স্বস্তিকার ব্যবহারের ফলে কিছু লোক স্বস্তিকার দুটি দিককে ভিন্ন দিক দিয়ে আলাদা করার চেষ্টা করছে ঘড়ির কাঁটার দিক থেকে তৈরি করার চেষ্টা করেছে। স্বস্তিকার নাৎসি সংস্করণটি ঘৃণা ও মৃত্যুকে বোঝায়।
তথ্যসুত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Swastika
https://www.britannica.com/topic/swastika
https://www.thoughtco.com/the-history-of-the-swastika-1778288
https://encyclopedia.ushmm.org/content/en/article/history-of-the-swastika