গভীর সমুদ্র মানেই এক গভীর রহস্য। আর এর মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে যখন গভীর সমুদ্রের নতুন নতুন খাঁদগুলি আবিষ্কার হয়েছে। এই অঞ্চলগুলিকে গভীর সমুদ্র পরিখা বলা হয়ে থাকে। সমুদ্রের সবচেয়ে বেশি গভীরতা পরিমাপ করা হয় মারিয়ানা ট্রেঞ্চের (mariana trench) চ্যালেঞ্জার ডিপ নামক স্থানে।
যেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সবসময়ের জন্য রহস্যময় এ উপত্যকা আমাদের গ্রহের ভূত্বকের ১১,০০০ মিটার (৩৬,০০০ ফুট) পর্যন্ত গভীরে গিয়ে ঠেকেছে। এটি এতই গভীর যে মাউন্ট এভারেস্টকে যদি গভীরতম পরিখার নীচে স্থাপন করা হয় তবে এর পাথুরে শীর্ষটি প্রশান্ত মহাসাগরের তরঙ্গগুলির থেকেও ১.৬ কিলোমিটার গভীরে অবস্থান করবে। মহাসাগরীয় ট্রেন্সগুলো সাধারণত সমুদ্রের তলদেশের টপোগ্রাফিক নিম্নচাপ, অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ, তবে খুব দীর্ঘ হয়ে থাকে।
ট্রেন্সগুলো প্রতিবছরই কয়েক মিলিমিটার থেকে দশ সেন্টিমিটারেরও বেশি পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে থাকে। সাধারণত আটলান্টিক এবং ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন অঞ্চল গুলিতে প্রায় ৫০ টিরও বেশি গভীর খাঁদ রয়েছে এবং যা গভীর সমুদ্রের ১.৯ মিলিয়ন কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিদ্যমান।
সমুদ্রের এ এসব এলাকাতে কখনই সমুদ্রপৃষ্ঠের মতো স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করে না। এ স্থান গুলিতে স্বাভাবিক জীবনের প্রকৃত রুপ কখনই পরিলক্ষিত হয়না।
ট্রেন্স বা খাঁদ সম্পর্কে ধারণা
সাধারনভাবে বলা যায় যে, টেকটনিক প্লেটগুলোর একে অপরের যায়গা পরিবর্তনের ফল স্বরূপ এ স্থানগুলির উদ্ভব হয়েছে। ১৯৪০ এবং ১৯৫০ এর দশক পর্যন্ত পরিখাগুলি বা ট্রেন্সগুলি সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িতই করা হয়নি।
১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং ২০ শতকের গোড়ার দিকে, যখন মহাদেশগুলির সমুদ্রতলে ট্রান্স্যাটল্যান্টিক টেলিগ্রাফ কেবলগুলি প্রথম স্থাপন করা হয়েছিল ততক্ষণ পর্যন্ত সমুদ্রের এসব বিষয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল খুবই সামান্য।
আমরা ট্রেন্স হিসেবে যে শব্দটি শুনে আসছি, প্রথমে কিন্তু কোন সময়ই ট্রেন্স নামটি ব্যাবহার হয়নি, এমনকি ১৯১২ সালে প্রকাশিত ক্লাসিক সমুদ্রবিদ্যা গ্রন্থেও “ট্রেঞ্চ” শব্দটির উল্লেখ নেই। এর পরিবর্তে সমুদ্র বিজ্ঞানীগণ গভীরতম এ অংশগুলির জন্য “গভীর” শব্দটি প্রয়োগ করেছিল, যেমন চ্যালেঞ্জার ডিপ নামটি প্রথমে ব্যাবহার হয়েছিলো।
সম্ভবত ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে এ খাঁদগুলির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার জন্য “ট্রেঞ্চ” শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল।
এসব অঞ্চলে অনেক বেশি আগ্নেয়গিরি এবং পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে। এগুলি মূলত টেকটোনিক প্লেট এবং এর গতির ফলস্বরূপ গঠিত হয়েছে। আপনি যদি পৃথিবীর ভু-বিজ্ঞান এবং টেকটোনিক প্লেটের গতির বিষয়ে অধ্যয়ন করা শুরু করেন, তবে দেখবেন এখানে ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির উতগিরন/বিস্ফোরণ অনেক বেশি ঘটে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, মারিয়ানা ট্রেন্স, যা প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে, মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের নিকটে অবস্থিত এবং জাপানের উপকূল থেকে খুব দূরে নয়, এবং এটি “সাবডাকশন” (সাবডাকশন একটি ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যেখানে টেকটনিক প্লেটগুলি সমান্তরাল সীমানায় স্থান পায় এবং এক প্লেট অন্যের অধীনে চলে যায়) নামে পরিচিত। খাদের নীচে, ইউরেশিয়ান এ প্লেটটি ফিলিপাইন প্লেট নামে পরিচিত।
১৭০ মিলিয়ন বছর আগে এটি ছোট্ট একটি ট্রেন্স এর উপর দিয়ে স্লাইড হয়ে যাওয়ার সময় ডুবে এবং গলে যায়। ডুবে এবং গলে যাওয়ার এই সমন্বয়টি মারিয়ানা ট্রেঞ্চকে তৈরি করেছিল।
বিশ্বের কিছু মহাসাগরীয় খাঁদ বা ট্রেন্স
বিশ্বের ০৭(সাত) টি মহাসাগরে বেশ কিছু মহাসাগরীয় খাঁদ বা ট্রেন্স বিদ্যমান। মানুষ সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এ খাঁদগুলিকে আবিষ্কার করেছে এবং গভীরে গিয়ে এর রহস্য জানার চেস্টা করছে।
এর মধ্যে রয়েছে ফিলিপাইন ট্রেন্স, টোঙ্গা ট্রেন্স, দক্ষিণ স্যান্ডউইচ ট্রেন্স, ইউরেশিয়ান বেসিন এবং মলয় ডিপ, ডায়াম্যান্টিনা ট্রেন্স, পুয়ের্তো রিকান ট্রেঞ্চ এবং মারিয়ানা ট্রেন্স।
এ গুলির বেশিরভাগই (তবে সবগুলিই নয়) সরাসরি সাবডাকশন প্রক্রিয়া বা প্লেটগুলি পৃথকভাবে চলাচলের সাথে সম্পর্কিত, এবং যা ঘটতে কয়েক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত সময় নেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডায়ামান্টিনা ট্রেঞ্চ গঠিত হয়েছিল বহু মিলিয়ন বছর আগে। এর ফলে অ্যান্টার্কটিকা এবং অস্ট্রেলিয়া আলাদা হয়ে নতুন মহাদেশে রুপ নেয়।
এই ক্রিয়াটি পৃথিবীর পৃষ্ঠতে ফাটল তৈরি করে এবং ফলস্বরূপ এ ফ্র্যাকচার হয়ে যাওয়া অঞ্চলটি খাদে/ট্রেন্সে পরিণত হয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে বেশিরভাগ গভীর পরিখা পাওয়া যায় যা তথাকথিত “রিং অফ ফায়ার” কে ছাপিয়ে যায়।
এসব অঞ্চল টেকটোনিক ক্রিয়াকলাপের কারণে এমন নাম পায়, যা জলের নীচে গভীর আগ্নেয়গিরির উত্থান হওয়ার পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ (Mariana Trench)
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২০০ কিলোমিটার (১২৪ মাইল) পূর্বে অবস্থিত, এবং এটি বিশ্বের গভীরতম খাঁদ। ট্রেঞ্চটির দৈর্ঘ্য পৃথিবীর ভূত্বকের প্রায় ২,৫৫০ কিমি (১,৫৮০ মাইল) এবং ৬৯ কিমি (৪৩ মাইল) প্রশস্ত। একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতির আকারের খাঁদ এটি।
চ্যালেঞ্জার ডিপ নামে পরিচিত মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মেঝেতে একটি ছোট স্লট-আকৃতির উপত্যকা রয়েছে, যার দক্ষিণ প্রান্তের সর্বাধিক গভীরতা ১০,৯৯৪ মিটার (৩৬,০৩৭ ফুট)। কোন কোন ক্ষেত্রে, কিছু ভিন্ন পরিমাপ পরিলক্ষিত হয়, যা ১১,০৩৪ মিটার (৩৬,২০১ ফুট)।
চ্যালেঞ্জার ডিপে জলের চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে 8 টন। যেখানে ১ ফুট গভীরতায় পানির চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে মাত্র ১৫ পাউন্ডের একটু বেশি।
এতো গভীরতায় পানির চাপ তাত্ক্ষণিকভাবে এতোটাই বেশি যে একজন ব্যক্তিকে খুব সহজেই হত্যা করতে পারে, তাই একটি নিরাপদ সাবমারসিবল নকশা করে পরীক্ষা না করা পর্যন্ত কেউ মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতায় যাওয়ার সাহস করে নি।
মারিয়ানা ট্র্যাঞ্চটির নামকরণ করা হয়েছিল এর কাছাকাছি অবস্থিত মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের নামে। ১৮৭৭ সালে খাঁদটিতে যখন প্রথম অনুসন্ধান চালানো হয় তখন এক ধরনের দড়ি ব্যাবহার করে এর গভীরতা নির্ণয় করা হয় ৮,১৮৪ মিটার (২৬,৮৫০ ফুট) এবং এ সময়ই একে চ্যালেঞ্জার ডিপ হিসেবে নাম করন করা হয়।
১৮৯৯ সালে ইউএসএস নেরো এর গভীরতা ৯,৬৩৬ মিটার বা ৩১,৬১৪ ফুট রেকর্ড করে। ১৯৫১ সালে, চ্যালেঞ্জার ডিপে ইকো সাউন্ডিংয়ের মাধ্যমে একটি সমীক্ষা করা হয়।
মূল অভিযানে ব্যবহৃত সাউন্ডিং সরঞ্জামগুলি, ড্র্যাগ লাইনের চেয়ে গভীরতা পরিমাপ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট এবং সহজ উপায় ছিল। এই সমীক্ষার সময়, এর গভীরতা পরিমাপ করা হয় ১০,৯০০ মিটার বা ৩৫,৭৬০ ফুট। তখনই মূলত এই পরিখার গভীরতম অংশটি রেকর্ড করা হয়েছিল।
১৯৫৭ সালে, সোভিয়েত জাহাজ ভিটিয়াজ, মারিয়ানা ফাঁপা নামে পরিচিত একটি জায়গায় ১১,০৩৪ মিটার (৩৬,২০১ ফুট) গভীরতার কথা জানিয়েছিল।
১৯৬২ সালে, জাহাজ এম.ভি. স্পেনসর এফ বেয়ার্ড নির্ভুলতা গভীরতার গেজ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ১০,৯১৫ মিটার (৩৫,৮১০ ফুট) গভীরতা রেকর্ড করে।
এরপর, বিভিন্ন সময়ে মারিয়ানা ট্র্যাঞ্চ এর উপর জরীপ চালানো হয় এবং গভীরতা একে অপরের খুব কাছাকাছি নির্ণয় করা হয়।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর নিচে মানুষের অনুসন্ধন
সমুদ্র বিজ্ঞানী জ্যাক পিকার্ড এবং ডন ওয়ালশ ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে ট্রাইস্ট নামে একটি বাথিস্কেপে করে চ্যালেঞ্জার ডিপ অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। নিমজ্জনকারী যানটি বিজ্ঞানীদের ৩৬,০০০ ফুট নিচে নিয়ে যেতে, ৫ ঘন্টা সময় লেগেছিল।
তারা সমুদ্রের তলায় মাত্র ২০ মিনিট সময় কাটাতে পেরেছিলেন , যেখানে তারা “ওজ” এবং কিছু চিংড়ি এবং মাছ দেখতে পান। এবং তাদের সমুদ্র পৃষ্ঠে ফিরে আসতে ৩ ঘন্টা সময় লেগেছিল। এরপর, ২৫ শে মার্চ, ২০১২, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার জেমস ক্যামেরন প্রথম ব্যক্তি যিনি পৃথিবীর গভীরতম বিন্দুতে একক ভ্রমণের মাধ্যমে যাত্রা করেছিলেন।
তার ২৪-ফুট লম্বা নিমজ্জনযোগ্য, ডিপসিয়া চ্যালেঞ্জারটি ২.৫ ঘন্টা চলার পরে ৩৫,৭৫৬ ফুট (১০,৮৯৮ মিটার) গভিরতায় পৌঁছায়। পিকার্ড এবং ওয়ালশের সংক্ষিপ্ত সফরের বিপরীতে, ক্যামেরন এই ট্রেঞ্চে ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করেছিলেন।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর জীব বৈচিত্র্য
১৯৬০ সালে পরিচালিত একটি অভিযানে পানির উচ্চ চাপের বিশয়ে বিস্মিত হয়েও কিছু পর্যবেক্ষণকারী দাবী করেন, যে এখানকার বৃহত্তর প্রাণীগুলি তুলনামুলক নীচে্র দিকে বাস করছে, এবং এগুলো প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) দীর্ঘ, কিছু চিংড়িও এখানে দেখতে পান তারা।
পিকার্ডের মতে, “নীচের অংশটি হালকা এবং স্পষ্ট দেখা গেছে,। তবে অনেক সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী এসব ফ্ল্যাটফিশের দেখাকে তাদের অনুমানের বিষয় বলে সন্দেহ করছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন যে এটির পরিবর্তে প্রাণীটি একটি সমুদ্রের শসা হতে পারে। দ্বিতীয় অভিযানের সময়, মানবহীন যানবাহন কাইকি এর দেয়াল থেকে কাদা্র নমুনা সংগ্রহ করেছিল।
কিছু ক্ষুদ্র প্রাণী সেই নমুনাগুলি থেকে পাওয়া গিয়েছিল, যারা সেখানে বাস করছিল। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ৮,১৪৫ মিটার গভীরতায় স্নেলফিশের একটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছিল, যা ভিডিওতে দেখা গভীরতম জীবন্ত মাছের আগের রেকর্ডটি ভেঙে দিয়েছিল।
এ অভিজানের সময় সুপারজিস্ট হিসাবে পরিচিত বিশাল ক্রাস্টাসিয়ান সহ বেশ কয়েকটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৮,১৭৮ মিটার গভীরে এক অজানা ধরণের স্নেলফিশ কামেয়ায় ধরা পরে।
আশ্চর্যের বিষয় হল, উচ্চ জলচাপ এবং শীতল তাপমাত্রা যা খাদের তলদেশে বিদ্যমান রয়েছে, তবুও এই কঠিন পরিবেশে জীবন ঠিকই তার বিকাশ লাভ করেছে। এটি ক্ষুদ্র এক-কোষযুক্ত জীব থেকে শুরু করে টিউবওয়ার্স এবং ক্রম বর্ধমান অন্যান্য উদ্ভিদ এবং প্রাণী থেকে শুরু করে কিছু অতি অদ্ভুত চেহারার মাছের অস্তিত্ব এখানে রয়েছে।
এছাড়াও, বহু পরিখার অভ্যন্তরে আগ্নেয়গিরির ভেন্টগুলি পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, যাকে “কালো ধূমপায়ী” বলে। এগুলি ক্রমাগত গভীর সমুদ্রের মধ্যে লাভা, তাপ এবং রাসায়নিক উপাদান উৎগিরন করে।
এই ভেন্টগুলি “স্ট্রিমোফিলস” নামক জীবনের জন্য প্রচুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে যা দুর্লভ পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ ছাড়াও আরও বেশ কিছু ট্রেঞ্চ রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনাঃ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ ছাড়াও আরও বেশ কিছু ট্রেঞ্চ রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে আমরা হয়তো অনেকেই খুব বেশি অবগত নই। সে গুলোর গভীরতাও কিন্তু খুব একটা কম নয়, মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর মতো সে স্থান গুলোতেও নানা রকমের জীব বৈচিত্র্য এবং অজানা রহস্য।
ফিলিপাইন ট্রেঞ্চ
ফিলিপাইন ট্রেঞ্চকে ফিলিপাইন ডিপ, মিন্ডানাও ট্রেঞ্চ এবং মিন্ডানাও ডিপ বলেও অভিহিত করা হয়। ফিলিপাইন দ্বীপের মধ্যভাগ থেকে ইন্দোনেশিয়ার হালমাহেরার উত্তর মালুকু দ্বীপ পর্যন্ত প্রসারিত এ ট্রেঞ্চ এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৩২০ কিলোমিটার (৮২০ মাইল) এবং প্রস্থ প্রায় ৩০কিলোমিটার (১৯ মাইল)।
ফিলিপাইন ট্রেঞ্চ আনুমানিক ৮-৯ মিলিয়ন বছর আগের এবং এটিকে সবথেকে কনিষ্ঠ বলে অনুমান করা হয়। প্লিও-প্লাইস্টোসিন এর সময় পৃথিবীর ভূত্বকের সক্রিয় পরিবর্তনের ফল বলে একে মনে করা হয়।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এবং টঙ্গা ট্রেঞ্চ এর পরে গভীরতার দিক দিয়ে ফিলিপাইন ট্রেঞ্চ ৩য় স্থানে রয়েছে। এর গভীরতম স্থানটি গ্যালাথিয়া পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত, এবং এর গভীরতা ১০,৫৪০ মিটার বা ৩৬,৫৮০ ফুট।
টঙ্গা ট্রেঞ্চ
টঙ্গা ট্রেঞ্চ দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত একটি মহাসাগরীয় খাঁদ বা ট্রেঞ্চ । এটি দক্ষিণ গোলার্ধের গভীরতম ট্রেঞ্চ এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় গভীরতম অঞ্চল। প্রশান্ত মহাসাগরের প্লেটটি পশ্চিমাঞ্চলে পতিত হওয়ার কারণে পৃথিবীতে দ্রুততম প্লেটে সাবডাকশন ঘটে এবং এর ফলে সৃষ্টি হয় টঙ্গা ট্রেঞ্চের।
এটি স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অফ ওশেনোগ্রাফি এর গবেষণা জাহাজ হরিজনের জন্য নামকরণ করা হয়েছে, এ জাহাজের ক্রুরা ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে গভীর এ স্থানটি খুঁজে পেয়েছিলেন।
২০১৯ সালের ৫ জুন ডিএসভি লিমিটিং ফ্যাক্টর নামে একটি সাবমারসিবল এ খাঁদের ১০,৮২৩ মিটার (৩৫,৫০৯ ফুট) নিচে পৌঁছায়। এটি ছিল এমন একটি মনুষ্যবাহী ডুবোযান, যার সাহায্যে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের ৪র্থ অভিযানের পর ৫ম অভিজান হিসেবে মানুষ এখানে পৌঁছায়।
এটি পৃথিবীর দ্রুত পরিবর্তনশীল প্লেট গুলোর একটি, এর ফলস্বরূপ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকম্পের অঞ্চল হিসেবে এ অঞ্চল পরিচিত।
যদিও বৃহত্তম ভূমিকম্পগুলির বেশিরভাগ উভয় টেকটোনিক প্লেটগুলির মধ্যে সংঘর্ষের কারনে ঘটে থাকে, এটি সাবডাকশন চলাকালীন ঘর্ষণের সাথে সম্পর্কিত একটি ঘটনা। অন্য ভুমিকম্পগুলি প্যাসিফিক প্লেট বাঁকানোর কারণে সৃষ্টি হয়।
টঙ্গা ট্রেঞ্চের উত্তর প্রান্তটি সম্ভবত ফিজির ফ্র্যাকচার জোনের সাথে যুক্ত, এটি ফিজির পূর্ব-পশ্চিম থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়েছে।
পুয়ের্তো রিকো ট্র্যাঞ্চ
পুয়ের্তো রিকো ট্র্যাঞ্চটির দৈর্ঘ্য ৮০০ কিলোমিটার (৪৯৭ মাইল) এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৮,৩৭৬ মিটার (২৭,৪৮০ ফুট) বা ৫.২০ মাইল। পুয়ের্তো রিকো ট্র্যাঞ্চটি ক্যারিবিয়ান সাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সীমানায় অবস্থিত।
১৯ ডিসেম্বর,২০১৮ তে ডিএসএসভি প্রেসার ড্রপের মাধ্যমে পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্চের সর্ব নিন্ম বিন্দু ব্রাউনসন ডিপের খোঁজ মেলে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে একটি আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে যে এই ফল্ট জোন ধরে ভূমিকম্পের ফলে একটি সুনামি তৈরি হতে পারে।
পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্চটিতে অনেক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে এবং এর ক্রিয়াকলাপ ঘন ঘন হয়ে থাকে। এ সক্রিয় আগ্নেয়গিরি গুলো ৮.০ মাত্রার চেয়ে বেশি ভূমিকম্প উত্পাদন করতে সক্ষম।
নাসাও বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক করেছে। ভূমিকম্প এবং সুনামির ঝুঁকি সম্পর্কে ট্রেঞ্চের নিকটে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের সাধারণ জনগণের মধ্যে এখনও তেমন একটা উদ্বেগ দেখা যায়নি। ১৯৮৮ সাল থেকে, পুয়ের্তো রিকান সিসমিক সোসাইটি মানুষকে ভবিষ্যতের ভূমিকম্প সম্পর্কে অবহিত করার জন্য পুয়ের্তোরিকান মিডিয়া ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।
তবে তারা ভাবছে ২০০৪ সালের সুনামির পরে ভারত মহাসাগরের চল্লিশটির ও বেশি দেশ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো এবং সে ঘটনা সেখানকার জনসাধারণকে যে ভাবে প্রভাবিত করেছিল, এখন যদি পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্চটি সম্পর্কে এ উদ্বেগ এর কথা বলা হয়, তবে না জানি কি অঘটনটাই না ঘটবে।
তথ্যসুত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Oceanic_trench
https://www.britannica.com/science/deep-sea-trench
https://www.throughtco.com/Oceanic_trench