ইবোলা হ’ল এক প্রকার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন ভাইরাস যা ইবোলা ভাইরাস (ebola virus) জনিত বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে থাকে। ইবোলা ভাইরাস জনিত রোগ একটি মারাত্মক অসুখ যা ভাইরাল হেমোরজিক জ্বর সৃষ্টি করে এবং ৯০% রোগীর ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হয়।
ইবোলা ভাইরাস (ebola virus) রক্তনালীর দেয়ালের ক্ষতি করে এবং রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। এর ফলে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয় যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী হতে পারে। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মূলত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায় এবং প্রায় সময়ই এ অঞ্চলের মানুষকে প্রচন্ডভাবে ঝুঁকির মধ্যে রাখে।
ইবোলা সাধারণত সংক্রামিত প্রাণীদের শারীরের তরলের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষের দেহে সঞ্চারিত হয়। এরপর এটি রক্ত এবং অন্যান্য শারীরিক তরলের সংস্পর্শের মাধ্যমে এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।
পরিবেশের দূষিত তরল পদার্থের সংস্পর্শের মাধ্যমেও এটি ছড়িয়ে যায়। ইবোলার বিভিন্ন উপসর্গ গুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, ডায়রিয়া, ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব, ডিহাইড্রেশন, কিডনি ও লিভারের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও কার্যকারিতা হারানো এবং অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ।
ইবোলা ভাইরাসের (ebola virus) গঠন প্রকৃতি
ইবোলা একটি একক এবং নেতিবাচক আরএনএ (RNA) ভাইরাস যা ভাইরাস পরিবার ফিলোভিরিডের অন্তর্গত। মারবুর্গ ভাইরাসগুলি ফিলোভিরিডে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাইরাস পরিবারটি তাদের রডের মতো শেপ, থ্রেডের মতো কাঠামো, বৈচিত্র্যময় দৈর্ঘ্য এবং এদের ঝিল্লিটি, আবদ্ধ ক্যাপসিড দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
ক্যাপসিড হ’ল একটি প্রোটিন কোট যা ভাইরাসের জেনেটিক উপাদানকে আবদ্ধ রাখে। ফিলোভিরিডে ভাইরাসে ক্যাপসিডটি একটি লিপিড ঝিল্লিতেও আবদ্ধ থাকে যেখানে হোস্ট সেল এবং ভাইরাল উপাদান উভয়ই থাকে। এই ঝিল্লি তার হোস্টকে সংক্রামিত করতে ভাইরাসটিকে সহায়তা করে।
ইবোলা ভাইরাসের সাধারন দৈর্ঘ্য ১৪,০০০ নানোমিটার এবং ব্যাসার্ধ ৮০ নানোমিটারের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কিছুটা বড় । এ ভাইরাসগুলো প্রায়ই একটি ইউ আকার ধারণ করে থাকে।
ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ
ইবোলা কোন ধরণের কোষের মাধ্যমে এবং ঠিক কোন পদ্ধতিতে সংক্রামিত হয়, তা জানা যায়নি। অন্যান্য ভাইরাসের মতো, ইবোলা পুনরায় নিজেকে তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কিছু উপাদানের অভাব দেখা যায়। এটি বংশ বিস্তার করতে কোষের রাইবোসোম এবং অন্যান্য সেলুলার ব্যবহার করে থাকে।
দেহ কোষের সাইটোপ্লাজমে ইবোলা ভাইরাস বংশ বৃদ্ধি করতে পারে বলে মনে করা হয়। কোষে প্রবেশের পরে, ভাইরাসটি ভাইরাল আরএনএ স্ট্র্যান্ড প্রতিলিপি করতে আরএনএ পলিমারেজ নামে একটি এনজাইম ব্যবহার করে। সংশ্লেষিত ভাইরাল আরএনএ (RNA) ট্রান্সক্রিপ্টটি মেসেঞ্জার আরএনএ ট্রান্সক্রিপ্টগুলির মতো, যা সাধারণত সেলুলার ডিএনএর বিস্তারের সময় উত্পাদিত হয়।
তারপরে কোষের রাইবোসোমগুলি ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করতে ভাইরাল আরএনএ (RNA) ট্রান্সক্রিপ্ট বার্তাটি অনুবাদ করে। ভাইরাল জিনোমটি সেলকে নতুন ভাইরাল উপাদান, আরএনএ এবং এনজাইম তৈরির নির্দেশ দেয়।
এই ভাইরাল উপাদানগুলি কোষের ঝিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে তারা নতুন ইবোলা ভাইরাস কণায় পরিনত হয়। ভাইরাসগুলি নতুন উদ্যমে হোস্ট সেল থেকে বেরিয়ে পরে নতুন ইনফেকশনের আশায়।
এ অবস্থায়, একটি ভাইরাস তার নিজস্ব ঝিল্লি খাম তৈরি করতে হোস্টের কোষের ঝিল্লির উপাদানগুলি ব্যবহার করে যা ভাইরাসকে আবদ্ধ করে এবং অবশেষে কোষের ঝিল্লি থেকে বেরিয়ে যায়।
আরও বেশি সংখ্যক ভাইরাস, কোষ থেকে যতটা সম্ভব বেরিয়ে পরে। কোষের ঝিল্লি উপাদান গুলো ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয় এবং কোষটি শেষ পর্যন্ত মারা যায়। মানব দেহের মধ্যে, ইবোলা ভাইরাস প্রাথমিকভাবে কৈশিক এবং অন্যান্য ধরণের শ্বেত রক্ত কোষের অভ্যন্তরের টিস্যু গুলোকে সংক্রামিত করে।
ইবোলার লক্ষণ
ইবোলা ভাইরাস (ebola virus) খুবই মারাত্মক। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তির প্রাথমিক উপসর্গগুলো অন্যান্য অনেক রোগের লক্ষণের সাথে একই রকম মনে হতে পারে, তাই অনেক সংক্রামিত লোক বেশ কয়েক দিন ধরে তাদের গুরুতর অবস্থা সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ থাকতে পারে।
ইবোলা আক্রান্তদের ক্ষেত্রে, বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিরা ইবোলা আক্রান্তের পরের দুই থেকে একুশ দিনের মধ্যে প্রথমিক লক্ষণগুলো দেখতে শুরু করেন। প্রথমদিকে, আক্রান্ত ব্যক্তি কেবল ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো লক্ষণগুলিই দেখতে পান।
জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, মাংশ পেশীর ব্যথা এবং গলা ব্যথার মতো লক্ষণগুলো দ্রুত প্রকাশ পেতে শুরু করে।
ভুক্তভোগীরা প্রায়শই ডায়রিয়া, বমি এবং ফুসকুড়ির মতো সমস্যায় ভোগেন। তারপরে আক্রান্ত ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক রক্তক্ষরন শুরু হয়।
বিস্তৃত গবেষণা সত্ত্বেও, ইবোলা ভাইরাসটির প্রথম সংক্রমণ প্রাকৃতিকভাবে কোথায় ঘটেছিল বা কেন এটি এতোটা মারাত্মক হয়ে উঠলো সে বিষয়ে এখনও কেউ নিশ্চিত হতে পারেনি।
আমরা যা জানি, তা হল ইবোলা ভাইরাস সাধারণত আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্ত বা অন্যান্য শারীরিক তরলের সংস্পর্শে এসে এক ব্যাক্তি থেকে অন্য ব্যাক্তির দেহে সংক্রামিত হয়।
বিজ্ঞানীরা ইবোলা ভাইরাসকে (ebola virus) ফিলোভাইরিডে ভাইরাস পরিবারের সদস্য হিসাবে মনোনীত করেছেন, যাকে ইবোলা হেমোরজিক ফিভার (ইএইচএফ) বলা হয়।
ইবোলা ভাইরাসের বর্তমানে পাঁচটি প্রাদুর্ভাবযুক্ত অঞ্চল রয়েছে। যেগুলো হল জায়ার, সুদান, কোট ডি’ভায়ার, বুন্দিবুগিয়ো এবং রেস্টন।
এখনও অবধি, জায়ার স্ট্রেন সবচেয়ে মারাত্মক, কারন এখানকার মৃত্যুর হার ৮০% এবং রেস্টনে সর্বনিম্ন মৃত্যুর হার ০% রয়েছে। যাইহোক, ইবোলা-জাইয়ের এবং ইবোলা-সুদান স্ট্রেনগুলিতে সমস্ত বড় আকারের ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।
ইবোলার চিকিৎসা
বিগত বছরগুলিতে, ইবোলা ভাইরাসের (ebola virus) কোনও চিকিত্সা, বিশেষকরে ভ্যাকসিন বা নিরাময়যোগ্য কোন ঔষধ আবিষ্কার হয়নি বলেই ইবোলার প্রকোপগুলি গুরুতর আকার নিয়েছে। ২০১৮ সালে, পূর্ব আফ্রিকার দেশ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে কঙ্গোয় ইবোলার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা ইবোলা নিশ্চিত হওয়া রোগীদের চিকিত্সার জন্য চারটি পরীক্ষামূলক চিকিত্সা পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। দুটি চিকিত্সা, যার মধ্যে একটিকে বলা হয়, রিজেনারন (আরইজিএন-ইবি ৩) এবং অন্যটিকে বলা হয়, এমএবি ১১৪, অন্যান্য দুটি চিকিত্সার চেয়ে এ দুটি বেশি সফল হয়েছিল।
এই দুটি পদ্ধতিতে যারা চিকিতসা নিয়েছিলেন তাদের বেঁচে থাকার হার অনেক বেশি ছিল। দুটি ওষুধই অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ এবং এটি বর্তমানে নিশ্চিত ইবোলা রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ওষুধগুলি ইবোলা ভাইরাসকে নিজের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হওয়া থেকে বিরত রাখে।
গবেষকগণ এ ভাইরাসের কার্যকর চিকিত্সা এবং ইবোলা ভাইরাসজনিত রোগের নিরাময়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
তথ্যসূত্রঃ- https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/ebola-virus-disease
https://www.webmd.com/a-to-z-guides/ebola-fever-virus-infection
https://www.cdc.gov/vhf/ebola/index.html