ভ্যাম্পায়ারদের বলা হয়, ভয়ংকর একপ্রকার অতিমাত্রায় খারাপ পৌরাণিক চরিত্র, যারা মানুষের রক্তকে তাদের খাবার হিসেবে বেছে নিয়েছিল। মানুষের রক্তের সন্ধানে, রাত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তারা ঘোরাফেরা করে থাকে। এরা হল সবচেয়ে সেরা পৌরাণিক ক্লাসিক দানব। বেশিরভাগ মানুষ ব্র্যাম স্টোকারের মহাকাব্যিক উপন্যাস, ড্রাকুলা পড়েছেন। তারা ভালোভাবেই জানেন এই কিংবদন্তি চরিত্রটি সম্পর্কে।
লেখক তার বইতে রক্ত চোষা কাউন্ট ড্রাকুলার সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই বর্ণনা করেছেন, এবং সেই সাথে ভ্যাম্পায়ারকে যুক্ত করেছেন। বিখ্যাত ড্রাকুলা গ্রন্থটি ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে অবাক করা বিষয় হল ব্র্যাম স্টোকারের জন্মের অনেক আগে থেকেই ভ্যাম্পায়ারের ইতিহাস শুরু হয়েছিল।
তিনি সেই সব ঘটনা থেকে তার লেখার জন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কিনা তা জানা সম্ভব হয়নি, তবে তিনি যে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, ঠিক সেরকম একটি চরিত্র কিন্তু বাস্তবে ছিল? তো কে ছিল সে? সেটাই আজ জানার চেস্টা করবো।
ভ্যাম্পায়ার কী?

কিংবদন্তী হিসাবে ভ্যাম্পায়ারের প্রায় বিভিন্ন ধরণের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিন্তু ভ্যাম্পায়ার (বা ভ্যাম্পায়ারস) এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল তারা মানুষের রক্ত পান করে এবং এর মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। তারা সাধারণত তাদের তীক্ষ্ণ দাঁত (কাল্পনিক) ব্যবহার করে তাদের শিকারের রক্ত পান করে। সেই সাথে তাদের হত্যা করে এবং নতুন ভ্যাম্পায়েরে পরিণত করে।
সাধারণত, সূর্যের আলো তাদের শক্তিকে দুর্বল করে দেয় এবং সে কারণে ভ্যাম্পায়াররা রাতে শিকার করতে বের হয়। মিথলজি অনুযায়ী কেউ কেউ বলেন, এদের নেকড়ের আকার ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে। ভ্যাম্পায়ারদের শক্তি প্রচন্ড এবং তারা তাদের আক্রান্তদের প্রায়শই সম্মোহিত করে ফেলে। তারা তাদের অবয়ব আয়নাতে দেখতে পারে না এবং তাদের কোন ছায়াও পারে না।
অভিশপ্ত ভ্লাদ (Vlad)

ব্রাম স্টোকার তার বিখ্যাত গ্রন্থের প্রধান চরিত্রটির নাম করনের ক্ষেত্রে একজন ব্যাক্তিকে অনুসরন করেছিলেন। তিনি ভ্লাদ ড্রাকুলার (Vlad Dracula) নামানুসারে “কাউন্ট ড্রাকুলার” নামকরণ করেছিলেন। এই ব্যাক্তি ভ্লাদ দ্য ইম্পেইলার (অভিশপ্ত ভ্লাদ) হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ভ্লাদ ড্রাকুলার জন্ম হয়েছিলো রোমানিয়ার ট্রানসিলভেনিয়ায়। তিনি ১৪৫৬-১৪৬২ সাল পর্যন্ত রোমানিয়ার ওয়ালাচিয়া রাজ্য শাসন করতেন।
কিছু ঐতিহাসিক তাঁকে অত্যান্ত নির্মম ও নিষ্ঠুর শাসক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন সেই ব্যাক্তি যিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের (অটোম্যান সম্রাজ্য) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি তার ডাকনামটি অর্জন করেছিলেন তার এক ধরণের বিশেষ বৈশিষ্টর কারণে। ভ্লাদ ড্রাকুলা তার শত্রুদের একটি বিশেষ উপায়ে হত্যা করতেন, আর এটা ছিল কাঠের একটি খন্ডকে তিনি তার শত্রুদের বুকে গেথে হত্যা করতেন।
কিংবদন্তি অনুসারে, ভ্লাদ ড্রাকুলা যাদের হত্যা করতেন, তাদের রক্তে তিনি রুটি ভিজিয়ে খেতেন এবং অবশ্যই এটা তিনি উপভোগ করতেন। এই গাল-গল্পগুলি সত্য কিনা তা কিন্তু সঠিকভাবে জানা যায় নি। পরবর্তীতে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এই গল্পগুলি ব্রাম স্টোকারের কল্পনা প্রসুত, এবং তিনি কাউন্ট ড্র্যাকুলা চরিত্রটিকে প্রচারের উদ্দেশ্যে এটা ব্যাবহার করেছিলেন। তিনি ট্রান্সিলভেনিয়া থেকেও এসেছিলেন, তিনি তার ভুক্তভোগীদের রক্ত খেতেন।
তবে, ড্রাকুলা বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ মিলারের মতে ব্রাম স্টোকার, কাউন্ট ড্রাকুলা চরিত্রটিকে ভ্লাদ ড্রাকুলার জীবনীর উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলেন নি। তবে যাইহোক, এ দুটি ড্রাকুলা চরিত্রর মধ্যে আকর্ষণীয় সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
ভ্যাম্পায়ার কি বাস্তব?

মধ্যযুগে ভ্যাম্পায়ারের কুসংস্কার প্রচন্ড পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিশেষত বুবেনিক প্লেগসহ একাধিক মধ্যযুগীয় মহামারী যখন ইউরোপের বিভিন্ন শহরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই রোগটি প্রায়শই ভুক্তভোগীদের মুখে এক ধরণের ক্ষত তৈরি করেছিলো। এটি এমন একটি ক্ষত ছিল যা, অনেক অশিক্ষিত মানুষের কাছে ভ্যাম্পায়ের কামরের একটি নিশ্চিত লক্ষণ হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়।
অপরিচিত শারীরিক বা মানুষিক অসুস্থতাকে অনেকেই ভ্যাম্পায়ার আক্রমণের লক্ষন হিসেবে সন্দেহ করতো। অনেক গবেষক আবার পোরফেরিয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন একে। এটি ছিল এক ধরণের রক্তের সমস্যা, যা ত্বকে মারাত্মক ফোস্কা সৃষ্টি করতে পারে এবং সূর্যের আলোতে এটি বেশি পরিমানে দৃষ্টি গোচর হয়। এমন একটি রোগ হিসাবে যা ভ্যাম্পায়ার কিংবদন্তির সাথে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
পোরফেরিয়ার কয়েকটি লক্ষণকে এক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ভ্যাম্পায়ার আক্রমণের বাইরে রাখা হয়েছিলো। তবে রেবিজ বা গাইটার এর লক্ষন গুলিকে সে সময়ের অনেকেই ভ্যাম্পায়ারের পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে গুলয়ে ফেলেছিল।
সে সময় সন্দেহভাজন ভ্যাম্পায়ার আক্রান্তদের দেহে রক্তচোষার সাধারন লক্ষণগুলির জন্য অনুসন্ধান চালানো হতো। কিছু ক্ষেত্রে, মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মৃতদেহে কাঠের দণ্ড গাথা হতো। আবার কিছু বর্ণনায় দেখা যায় উনিশ শতকে সন্দেহজনক মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হতো।
মার্সি ব্রাউন কি ভ্যাম্পায়ার ছিল?
মার্সি ব্রাউন আমেরিকার একজন কুখ্যাত ব্যাক্তি ছিলেন, যাকে ভ্যাম্পায়ার হিসাবে কাউন্ট ড্রাকুলার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া যেতে পারে। কাল্পনিক চরিত্র কাউন্ট ড্রাকুলার মতো, মার্সি একজন সত্যিকারের মানুষ ছিলেন। তিনি আমেরিকার রোড আইল্যান্ডের এক্সেটারে থাকতেন এবং তার বাবার নাম ছিল জর্জ ব্রাউন। তিনি ছিলেন একজন কৃষক।
১৮০০ এর শতকের শেষদিকে এই জর্জ ব্রাউন তার মেয়ে মার্সি সহ পরিবারের অনেক সদস্য যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আশেপাশের অনেক প্রতিবেশি তাদের মৃত্যুর জন্য মার্সি ব্রাউনকে বলির পাঠা হিসেবে দোষ চাপিয়েছিল।
এ সকল মানুষগুলো ধারণা করেছিলো যে, মার্সি ছিল ভ্যাম্পায়ার এবং তিনিই পরিবারের সকলকে হত্যা করেছেন। এমনকি তারা জর্জের পরিবারের সকল সদস্যের মৃতদেহকে পরীক্ষা করেছিলো এই ভেবে যে, তাদের দেহে কোন ভ্যাম্পায়ারের কামড়ের দাগ আছে কি না?
যখন মার্সির দেহটি সমাহিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন একটা দুঃখ জনক পরিস্থিতির অবতারনা হয়েছিলো। নিউ ইংল্যান্ডের সে প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়াতে তার দেহটিকে একটি গ্রাউন্ডের উপরে রাখা হয়েছিল, সেখানে উপস্থিত জনগণ এবং নগরবাসী তার বিরুদ্ধে ভ্যাম্পায়ার হওয়ার অভিযোগ এনেছিল। তারা তার বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে নিয়ে এসেছিলো এবং সেটা কেটে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো।
সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ার
যদিও আধুনিক বিজ্ঞান অতীতের সব ভ্যাম্পায়ারের ভয়কে অনেকটাই দূর করেছে। তবে অনেকেই নিজেকে ভ্যাম্পায়ার বলে জাহির করেছে বিভিন্ন সময়। অদ্ভুত বিষয় হল, তারা দেখতে সাধারণ সুস্থ মানুষের মতোই এবং এরা সম্ভবত ভুল পথে চালিত হয়ে অল্প পরিমাণে রক্ত পানও করে থাকে। স্ব-ঘোষিত ভ্যাম্পায়ার সম্প্রদায়গুলি ইন্টারনেটে এবং বিশ্বের বিভিন্ন শহরে গোপনে তাদের প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিছু ভ্যাম্পায়ার মানুষের রক্ত গ্রহণ করে না, তবে অন্যের শক্তি খাওয়ার দাবি করে। অনেকের বক্তব্য যে তারা যদি নিয়মিত খাবার না দেয় তবে তারা উত্তেজিত বা হতাশায় পরিণত হয়।
ড্রাকুলা প্রকাশের পরে ভ্যাম্পায়াররা মূলধারায় পরিণত হয়েছিল। সেই থেকে কাউন্ট ড্রাকুলার কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব অনেকগুলি চলচ্চিত্র, বই এবং টেলিভিশন শোগুলির বিষয়বস্তু হয়ে যায়। এ লোকেরা সমস্ত কিছুর প্রতি মুগ্ধতার কারণে, ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্বকে বাস্তব বা কল্পনা হিসেবে তাদের মনে বেশ ভালোভাবেই স্থান দিয়েছে এবং আগত কয়েক বছর ধরে এটি পৃথিবীতে বাস করবে বলাই বাহুল্য।
https://www.history.com/topics/folklore/vampire-history
http://www.ucs.mun.ca/~emiller/elizabeth_miller.html
https://blogs.scientificamerican.com/primate-diaries/a-natural-history-of-vampires/