কাশ্মীরের (kashmir) ইতিহাস। অঞ্চলটি সরকারীভাবে জম্মু ও কাশ্মীর হিসাবে পরিচিত

কাশ্মীরের (kashmir) ইতিহাস অনেক বিস্তৃত। সরকারীভাবে এ অঞ্চলটি জম্মু ও কাশ্মীর নামে পরিচিত। এটি উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানের ৮৬,০০০ বর্গমাইল মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত সংঘাতময় একটি অঞ্চল।

কাশ্মীরের সৌন্দর্য এতটাই বিচ্ছুরিত হয়েছিলো যে ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর মোঘল সম্রাটরা এ স্থানকে পার্থিব স্বর্গ হিসাবে বিবেচনা করতো।

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সহিংসভাবে বিতর্কিত হয়ে আসছে। তাছাড়া, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের একটি বিছিন্ন মুসলিম অঞ্চল হিসাবে ইতিহাসই একে তৈরি করেছিল।

 

কাশ্মীরের ইতিহাস

শত শত বছরের হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনের পরে, ১৫শ শতাব্দীতে মুসলিম মোঘল সম্রাটরা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। তারা এখানকার সাধারন জনগণকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিল এবং মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

তবে এ বিষয়টি অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ইসলামী মোঘল শাসনকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে  আধুনিক স্বৈরাচারী ইসলামী শাসনব্যবস্থার সাথে মিশিয়ে ফেলা একেবারেই উচিত হবে না।

মোঘল সাম্রাজ্যর সবচেয়ে সফল সম্রাট, আকবর দ্য গ্রেট (১৫৪২-১৬০৫) এর পছন্দ অনুসারে ইউরো্পে ইসলামের আলোকিত ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক শতাব্দী পরে মোঘলরা পরম সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদের আলোকিত আদর্শকে ফুটিয়ে তুলেছিল।

জিহাদী-কট্টর পন্থায় অনুপ্রাণিত ইসলামী মোল্লাদের উত্থানের আগে মোঘলরা ভারতীয় উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথে পরবর্তী সূফী-শান্তিপূর্ণ ইসলামের অনুপ্রেরণামূলক রূপের উপর তাদের অবদান রেখে গেছে।

আফগান হানাদাররা ১৮শ শতাব্দীতে মোগলদের অনুসরণ করে এ অঞ্চলে আগমন করে। এরপর, উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজরা কাশ্মীর আক্রমণ করে এবং পুরো কাশ্মীর উপত্যকা অর্ধ মিলিয়ন রুপিতে (প্রতি কাশ্মীরির জন্যে তিন টাকা) জম্মুর তৎকালীন নৃশংস অত্যাচারী শাসক হিন্দু গুলব সিংহের কাছে  বিক্রি করে।

আর এভাবেই, গুলব সিংহের তকালি কাশ্মীর উপত্যকা জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অংশে পরিণত হয়।

 

১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাজন ও কাশ্মীর যুদ্ধ 

কাশ্মীর যুদ্ধ
কাশ্মীর যুদ্ধ

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যায়। সাথে সাথে কাশ্মীরও বিভক্ত হয়েছিল। এর  দুই-তৃতীয়াংশ ভারতে এবং বাকি অংশ পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়। যদিও ভারতের অংশটির জনগণ মূলত পাকিস্তানের মতোই মুসলমান ছিল। আর  ভারত বিভাগের সময় থেকেই মুসলমানরা বিদ্রোহ শুরু করেছিল।

তারা সে সময় অভিযোগ করছিল যে, ভারত তাদের উপর দমন নিপীড়ন চালাচ্ছে। এজে,তার ফলশ্রুতিতে এ অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হয়।

১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি এবং কাশ্মীরিদের নিজেদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে একটি গণভোট বা মতামত গঠনের আহ্বানমূলক একটি প্রস্তাব না হওয়া পর্যন্ত এ যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়নি। যদিও, ভারত জাতিসংঘের এই রেজোলিউশনটি কখনও কার্যকর করেনি। 

 

পরিবর্তে, ভারত স্থানীয়দের নিকট ক্ষোভের মাত্রা বাড়িয়ে কাশ্মীরে একটি দখলদার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।

কাশ্মীরের (kashmir) ইতিহাসে আধুনিক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা – জওহরলাল নেহেরু এবং মহাত্মা গান্ধী – উভয়েরই কাশ্মীরের সাথে একপ্রকার শিকড়ের বন্ধন ছিল, যা এই অঞ্চলের সাথে ভারতের সংযুক্তি খুব ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করে। ভারতের কিছু নেতার কাছে, কাশ্মীরের অর্থ আসলে কিছুই নয়।

ভারতীয় নেতাদের স্ট্যান্ডার্ড লাইন এবং একমাত্র কথা হ’ল কাশ্মীর ভারতের “অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ”।

১৯৬৫ সালে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৭ সালের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি বড় যুদ্ধের দ্বিতীয় যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। তবে এ যুদ্ধের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনই মূলত দায়ী ছিল।

যুদ্ধ শুরুর তিন সপ্তাহ পরে যুদ্ধবিরতির ফলে উভয়পক্ষের পক্ষ থেকে অস্ত্র সংবরণ করা হয়। ১৯৪৯ সালের জাতিসংঘের একটি প্রস্তাব অনুসারে, এ সময় পাকিস্তান এই অঞ্চলের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য কাশ্মীরের বেশিরভাগ মুসলিম জনসংখ্যার দ্বারা গণভোটের আহ্বান জানায়, কিন্তু ভারত এটা আমলেই নেয়নি। উল্টো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে।

১৯৬৫ সালের যুদ্ধে, সংক্ষেপে বলা যায়, আসলে কিছুই মীমাংসিত হয়নি।

 

কাশ্মীর-তালিবান সংযোগ

মুহাম্মদ জিয়া উল হকের ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে (পাকিস্তানি একনায়ক যিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন), পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার দিকে ঝুঁকতে  শুরু করে।

জিয়া ইসলামপন্থীদের সাথে তার ক্ষমতাকে একপ্রকার একীভুত করে ফেলেন এবং এ অবস্থা বজায় রাখার একটি চেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং বলা যায় সফল হয়েছিলেন।

১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী মুজাহিদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে, জেনারেল জিয়াউল হক ওয়াশিংটনের দয়া লাভ করতে সক্ষম হন।

সোভিয়েত বিরোধী আফগান বিদ্রোহীদের খাওয়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জিয়ার মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে নগদ অর্থ ও অস্ত্র প্রদান করেছিল। তিনি আমেরিকাকে বোঝাতে সক্ষন হন যে, তিনি এগুলোর দেখভাল যথার্থ ভাবেই করবেন। যদিও ওয়াশিংটন এটা স্বীকারও করেছে।

এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে জিয়া দুটি প্রকল্পে প্রচুর পরিমাণে আমেরিকান নগদ অর্থ ও অস্ত্র সরিয়ে নিয়েছিলেন। এর একটি পাকিস্তানের পারমাণবিক-অস্ত্র কর্মসূচী এবং অন্যটি কাশ্মীরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি ইসলামপন্থী শক্তি তৈরি করা।

জিয়া উভয় ক্ষেত্রেই মূলত সফল হন। তিনি আফগানিস্তানের সশস্ত্র শিবিরগুলিকে প্রচুর অর্থ ও সুরক্ষা দিয়েছিলেন, এবং কাশ্মীরে ব্যবহার করা হবে এমন জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

পাকিস্তানি মাদ্রাসাগুলোতে এবং পাকিস্তানের উপজাতি অঞ্চলগুলোতে আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে পাকিস্তানের প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে এমন একটি কঠোর ইসলামপন্থী বাহিনীর উত্থানকে প্রচন্ডভাবে সমর্থন করেছিলেন।

আর এভাবেই, কাশ্মীরের ইতিহাসে রাজনৈতিক জঙ্গিবাদ, উত্তর ও পশ্চিম পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে ইসলামবাদের উত্থানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত রয়েছে।

 

আজকের কাশ্মীর 

অগ্নিগর্ভ কাশ্মীর
অগ্নিগর্ভ কাশ্মীর

বর্তমানে কাশ্মীরের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। ১৯৮৯ সালের পর থেকে এই অঞ্চলে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ চলছে। ১৯৯৯ সালের কার্গিল সংঘর্ষের পরে যখন উত্তেজনা তীব্রতর ছিল, তখন পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ থেকে ছয় সপ্তাহ ব্যাপী রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হয়েছিল। “

২০০১ সালের শুরুর দিকে কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়, তৎকালীন আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট কলিন পাওয়েলের ভুমিকা ব্যক্তিগতভাবে এ অঞ্চলের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলো।

সে বছরের শেষদিকে যখন ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য বিধানসভায় বোমা ফেটেছিল এবং একটি সশস্ত্র দল নয়া দিল্লিতে ভারতীয় সংসদ ভবনে আক্রমণ করেছিল, তখন ভারত কাশ্মীর সীমান্তে ৭,০০,০০০ সৈন্যকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করেছিল, যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিল এবং পাকিস্তানকে এ অঞ্চলে তার বাহিনী একত্রিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। 

আমেরিকান হস্তক্ষেপ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফকে কিছু কার্যক্রম গ্রহন করতে বাধ্য করেছিল, এর ফলে মোশারফ ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধকে উস্কে দেওয়া এবং পরবর্তীকালে জানুয়ারিতে পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদী সত্তার উপস্থিতি শেষ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। সেই সাথে কাশ্মীরকে আরও সামরিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।

তিনি জেমাহ ইসলামিয়া, লস্কর-ই-তৈয়বা, এবং জাইশ-ই-মোহাম্মদসহ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ ও নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

মোশাররফের প্রতিশ্রুতি যথারীতি শূন্য প্রমাণিত হয়েছিল। কাশ্মীরে সহিংসতা অব্যাহত ছিল এবং এখনো বিদ্যমান রয়েছে। ২০০২ সালের মে মাসে, কালুচকের একটি ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলায় ৩৪ জন মারা যায়, যার বেশিরভাগই ছিল মহিলা এবং শিশু। এই আক্রমণ আবার পাকিস্তান ও ভারতকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসে। 

কাশ্মীরের (kashmir) ইতিহাস আরব-ইস্রায়েলি দ্বন্দ্বের মতো একই দিকে প্রবাহমান। এবং এ দ্বন্দ্বের আশু সমাধান সম্ভব কি না এ ধারনাটিও বিতর্কিত। 

 

 

তথ্যসুত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Kashmir

https://www.britannica.com/place/Kashmir-region-Indian-subcontinent

https://en.wikipedia.org/wiki/Jammu_and_Kashmir_(state)

2 thoughts on “কাশ্মীরের (kashmir) ইতিহাস। অঞ্চলটি সরকারীভাবে জম্মু ও কাশ্মীর হিসাবে পরিচিত”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top