হিটলার এবং স্টালিনের মধ্যে ১৯৩৯ সালে সম্পাদিত চুক্তি
১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট, নাৎসি জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন নাজি-সোভিয়েত অ-আগ্রাসন চুক্তি নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিকে জার্মান-সোভিয়েত অ-আগ্রাসন চুক্তি যা রিবেনট্রপ-মোলোটভ চুক্তি নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই চুক্তির মাধ্যমে দু’ই নেতা মুলত পারস্পরিক একটি নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে তারা কেউই একে অন্যকে আক্রমণ করবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসন্নতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠার সাথে সাথে, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে কার্যত নাতসি-সভিয়েত সম্মুখ যুদ্ধের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যায়, যা মুলত জার্মানদের এই গ্যারান্টি দিয়েছিলো যে অন্তত জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা আক্রান্ত হবেনা। এই চুক্তির একটি গোপন সংযোজনের অংশ হিসেবে, পোল্যান্ড এবং বাল্টিক রাজ্যগুলির কিছু অংশ সহ সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিস্ত্রিন ভূমি প্রদান করা হয়েছিল।
কিন্তু ভাবা হয় এক, আর হয়ে যায় অন্য কিছু। আসলে এই চুক্তিটিও ভঙ্গ করা হয়েছিল জার্মানির পক্ষ থেকে। যখন নাজি জার্মানি, এই চুক্তি সম্পাদনের দু’বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, ১৯৪১ সালের ২২ শে জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছিল।
হিটলার কেন চুক্তি করতে চেয়েছিলেন?
১৯৩৯ সালে এডলফ হিটলার যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন জার্মানরা, বিশেশ করে হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো একই ভুলগুলি পুনরায় না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। যদিও তিনি আশা করেছিলেন, যে বিনা বাধায় বা জোর করে হলেও তিনি পোল্যান্ড দখল করবেন, যেটা তিনি এক বছর আগে অস্ট্রিয়ার সাথে করেছিলেন। আর এ কারনে, পলান্ডের বিরুদ্ধে তার আগ্রাসনের ফলাফল হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে, সম্মুখ যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তা ছিল।
ত্রিপক্ষীয় জোটের ব্রিটিশ-সোভিয়েত-ফরাসী আলোচনার বিরতি কালিন সময়ে চুক্তিটি ১৯৩৯ সালের আগস্টের প্রথম দিকে সম্পাদিত হয়েছিলো। রাশিয়ান সূত্রের মতে, এই ত্রিপক্ষিয় জোট একটি সফল আলচনায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ পোল্যান্ড এবং রোমানিয়া তাদের অঞ্চলে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীকে প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকার করেছিল আর তাতে সমর্থন দিয়েছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্স।
আর সে সময় জোসেফ স্টালিন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলাইন এবং তার ইংল্যান্ড কনজারভেটিভ পার্টিকে কার্যত অবিশ্বাস করেছিলেন এবং স্টালিন বিশ্বাস করেছিলেন, ব্রিটেন রাশিয়ার স্বার্থকে পুরোপুরি সমর্থন করবে না। সুতরাং, নাৎসি-সোভিয়েত অ-আগ্রাসন চুক্তির জন্য একটি বিপুল সম্ভাবনার দার উন্মোচিত হয়েছিলো।
দু’পক্ষের সাক্ষাৎ
১৯৩৯ সালের ১৪ ই আগস্ট, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াকিম ফন রিবেন্ট্রপ একটি চুক্তি করার জন্য সোভিয়েতদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। রিবেন্ট্রপ মস্কোয় সোভিয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈচেস্লাভ মোলোটভের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং তারা একসাথে দুটি প্যাসেটের ব্যবস্থা করেছিলেন: যাতে অর্থনৈতিক চুক্তি এবং নাজি-সোভিয়েত অ-আগ্রাসন চুক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অর্থনৈতিক চুক্তি
প্রথম চুক্তিটি ছিল একটি অর্থনৈতিক বাণিজ্য চুক্তি, যা রিবেন্ট্রপ এবং মোলোটভ ১৯৩৯ সালের ১৯ আগস্ট স্বাক্ষর করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে, জার্মানিকে ব্রিটিশ অবরোধ অতিক্রম করতে সহায়তা করার এই চুক্তিটি সোভিয়েত ইউনিয়নকে জার্মান যন্ত্রপাতি সম্পর্কিত পণ্যগুলির বিনিময়ে তাদের খাদ্য পণ্য এবং কাঁচামাল সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
অ-আগ্রাসন চুক্তি
অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের চার দিন পরে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ১৯৩৯ সালের, ২৩ আগস্ট, রিবেন্ট্রপ এবং মোলোটভ নাজি-সোভিয়েত অ-আগ্রাসন চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
প্রকাশ্যে, এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন একে অপরকে আক্রমণ করবে না এবং দুই দেশের মধ্যে যে কোনও সমস্যা দেখা দিতে পারে, তবে তা বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে পরিচালনা এবং মীমাংসা করা উচিত। এই চুক্তিটি, ১০ বছর স্থায়ী হবে বলে বলা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ২ বছরের চেয়েও কম সময় এটি স্থায়ী হয়েছিল।
চুক্তির শর্তাদির মধ্যে ছিল, জার্মানি যদি পোল্যান্ড আক্রমণ করে তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডকে সহায়তা করবে না। সুতরাং, জার্মানি পোল্যান্ডের উপর দিয়ে পশ্চিমের (বিশেষত ফ্রান্স এবং গ্রেট ব্রিটেন) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে সোভিয়েতরা গ্যারান্টি দিয়েছিল যে তারা যুদ্ধে প্রবেশ করবে না।
চুক্তি ছাড়াও, রিবেন্ট্রপ এবং মোলোটভ চুক্তিতে একটি গোপন প্রোটোকল যুক্ত করেছিলেন – এটি একটি গোপন সংযোজন, যার অস্তিত্ব ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন অস্বীকার করেছিল।
জার্মান রাইখ চ্যান্সেলর হের হিটলারের কাছে,
” চিঠির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আশা করি যে জার্মান-সোভিয়েত ননাগ্রেগ্রেশন চুক্তি আমাদের দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য একটি নির্ধারক মোড় চিহ্নিত করবে।”
” জে. স্ট্যালিন ”
সিক্রেট প্রোটোকল
গোপন প্রোটোকলটি নাৎসি ও সোভিয়েতদের মধ্যে একটি চুক্তি ছিল যা পূর্ব ইউরোপকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। আসন্ন যুদ্ধে ব্যস্ততা হ্রাস করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাল্টিক স্টেটস যেমন এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া দিয়েছিল এবং পোল্যান্ডকে নরও, ভিস্তুলা এবং সান নদী দিয়ে বিভক্ত করে দ্যটি দেশ ভাগ করে নিয়েছিল।
এই ধরনের অঞ্চলিক পুনর্গঠন সোভিয়েত ইউনিয়নকে অভ্যন্তরীণ বাফারের মাধ্যমে পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে এক স্তরের সুরক্ষা প্রদান করেছিল।
চুক্তি যেভাবে কার্যকর হয়েছিলো
১৯৩৯ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর সকালে নাৎসিরা পোল্যান্ডে আক্রমণ করলে সোভিয়েতরা সেটা দাঁড়িয়ে দারিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিল শুধু। এর দু’দিন পরে অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের যুদ্ধের ঘোষণার মাধ্যমে। গোপন প্রোটোকল অনুসারে সোভিয়েতরা তাদের “প্রভাবের ক্ষেত্র” দখল করার জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পোল্যান্ডে প্রবেশ করেছিল।
এই পদ্ধতিতে, নাৎসি-সোভিয়েত অ-আগ্রাসন চুক্তি কার্যকরভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধা দেয়, এইভাবে দ্বি-সম্মুখ যুদ্ধ থেকে তার সীমানা গুলো রক্ষার চেষ্টায় জার্মানি সাফল্যের মুখোমুখি হয়েছিল।
জার্মানি দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়নের আশ্চর্য আক্রমণ এবং ১৯৪২ সালের ২২ শে জুনের আক্রমণ পর্যন্ত নাৎসি ও সোভিয়েত কত্রিপক্ষ চুক্তি এবং প্রোটোকলের শর্তাবলী রক্ষা করেছিল। ৩ জুলাই স্ট্যালিন রাশিয়ান জনগণকে জানিয়েছিলেন আগ্রাসন চুক্তি এবং জার্মানির সাথে যুদ্ধের ঘোষণা, এবং 12 জুলাই, অ্যাংলো-সোভিয়েত পারস্পরিক সহায়তা চুক্তি কার্যকর হয়েছিল।
Source :
https://www.thoughtco.com/nazi-soviet-non-aggression-pact-1779994
https://en.wikipedia.org/wiki/Molotov%E2%80%93Ribbentrop_Pact
https://encyclopedia.ushmm.org/content/en/article/german-soviet-pact