Hubble-Telescope

হাবল টেলিস্কোপ; মহাবিশ্ব অনুসন্ধানে এক বিস্ময়কর আবিষ্কার।

মহাবিশ্বকে জানার উদ্দেশ্যে মানুষের দ্বারা যতগুলো আবিস্কার হয়েছে, তার মধ্যে হাবল টেলিস্কোপ প্রথম দিকেই থাকবে বলে অনেকেই মনে করেন। এমনকি অনেকে এটাও ভাবেন, যে মানুষের চন্দ্র বিজয় থেকেও হাবল টেলিস্কপের উদ্ভাবন, মহাকাশ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে তো বটেই, সেই সাথে মহাবিশ্বকে চেনার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সৃষ্টিকর্তা যে বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তৈরি করেছেন, সে তুলনায় অতি সামান্য হলেও, তার সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছুটা হলেও আমরা জানতে পেরেছি এই হাবল টেলিস্কোপ আবিস্কার হওয়ার পরেই। 

১৯৯০ সালে হাবল টেলিস্কোপ তার জাত্রা শুরু করলেও, গত ১৩ জুন, এটি তার কার্যক্রম থামিয়ে দেয়। বিগত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে হাবল টেলিস্কোপ, মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের অনেক ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। চলুন জেনে নেয়া যাক হাবল টেলিস্কোপের আদ্যোপান্ত।

হাবল টেলিস্কোপ আবিষ্কারের শুরুর কথা

Galileo Telescope Invention
Galileo Telescope Invention

মানব সভ্যতার সূর্যোদয়ের পর থেকে মানুষ তাদের দৃষ্টি ও কল্পনার মাধ্যমে মহাবিশ্বকে বোঝার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে টেলিস্কোপের ধারনা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বাড়িয়ে তোলে। ১৬ ও ১৭ শ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী কোপারনিকাস, গ্যালিলিও এবং কেপলারের পর্যবেক্ষণ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে পৃথিবীর হাজার বছরের পুরানো ধারণাটিকে এক প্রকার প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে, আবিস্কার হওয়া দূরবীন, মহাজাগতিক বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি অপরিহার্য উপকরণে পরিণত হয়।

মুলত সে সময় থেকেই আরও বড় এবং উন্নত টেলিস্কোপগুলি সারা বিশ্ব জুড়ে নির্মিত হচ্ছিলো। খালি চোখে দেখা যায়নি এমন গ্রহ, তারা এবং নীহারিকাকে নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিলো এবং নোট করা হচ্ছিলো।

এডউইন হাবলের গবেষণা

Edwin Hubble

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বেশিরভাগ জ্যোতির্বিজ্ঞানীর বিশ্বাস ছিল যে, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব একটি ছায়াপথ, আমাদের মিল্কিওয়ে, নক্ষত্র, ধুলা এবং গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। তবে, ১৯২৪ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল মাত্র ১০০ ইঞ্চির হুকার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে, আমাদের নিজস্ব মিল্কিওয়ের পাশাপাশি আরও অনেক ছায়াপথ সম্পর্কে অধ্যয়ন শুরু করেছিলেন, এবং আবিস্কার করেছিলেন যে তারা প্রায় একে অপর থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ তিনি বঝাতে চেয়েছিলেন প্রতিনিয়ত মহাবিশ্বের প্রসার ঘটছে।

হাবল স্পেস টেলিস্কোপ আবিষ্কার

Hubble Space Telescope Support Systems Module
Hubble Space Telescope Support Systems Module

এর পরে ১৯৩৩ সালের প্রথম দিকে একটি স্পেস টেলিস্কোপ তৈরির প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারনে এ প্রকল্পটি আর নাসার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৩ সালে নাসার একটি উৎক্ষেপণকে সামনে রেখে ১৯৭০ সালে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ নিরমানের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়, কিন্তু প্রকল্পটি প্রযুক্তিগত জটিলতা, এবং বাজেট সমস্যার কারনে আর সয়াপ্ত করা সম্ভব হয়নি।

তবে শেষ, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার সহায়তায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা, হাবল স্পেস টেলিস্কোপ তৈরি করে। ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল ডিসকভারির মাধ্যমে এটিকে মহাকাশে প্রেরন করা হয়, এবং পৃথিবী থেকে ৫৫০ কিলমিটার দূরে পৃথিবীর কক্ষপথে চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এর মূল আয়নাটি ভুলভাবে সংযুক্ত করার কারনে প্রথমদিকে এর থেকে ভালো ছবি পাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে এই টেলিস্কোপের এখাধিক সংস্কার করতে হয়েছে। 

নতুনণত্বের ধারণার প্রবর্তক জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবলের সম্মানে নামকরণ করা হাবল স্পেস টেলিস্কোপ একটি বৃহত, মহাকাশ পর্যবেক্ষণকারী ডিভাইস। প্রথমদিকে হাবলকে ১৫ বছরের জন্য ডিজাইন করা হলেও একধিক সংস্কারের পরে গত ৩০ বছর এটি মানুষকে নতুনণত্বের সন্ধান এনে দিয়েছে।

মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণে হাবল টেলিস্কোপের অবদান 

Spiral-galaxy
Spiral-galaxy

হাবল টেলিস্কপে একটি 2.4 মিটার বা ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি আয়না যুক্ত করা হয়েছিলো এবং এর চারটি প্রধান যন্ত্রের সাহায্যে মহাকাশের তড়িৎ চৌম্বকীয় বর্ণালীর অতিবেগুনী রশ্মি, দৃশ্যমান এবং নিকটস্থ-ইনফ্রারেড অঞ্চলগুলিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য তইরি করা হয়েছিলো।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে হাবলের কক্ষপথ, হাবলকে পৃথিবীতে অবস্থিত টেলিস্কোপের চেয়ে যথেষ্ট কম আলোতেও অত্যন্ত হাই-রেজোলিউশনের ছবিগুলি ক্যাপচার করতে দেয়। এটি মহাকাশে গভীর তাকিয়ে এর ভেতরের ছবিগুল অনায়াসেই তুলতে পারে।

হাবল তার সময়কালে ১৫ লক্ষেরও বেশি পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেছে। কর্মজীবনে হাবল এখন পর্যন্ত যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক অবদান রেখেছে, তার একটি বিস্তৃত তালিকা সরবরাহ করা প্রায় অসম্ভব হলেও, দূরবীনটির পর্যবেক্ষণে ছায়াপথের বিকাশ এবং এর বিস্তৃতি বোঝার ক্ষেত্রে বিপুল অবদান রেখেছে।

বেশিরভাগ ছায়াপথগুলিতে ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি, তাদের জন্ম, তারা এবং আমাদের সৌরজগতের বাইরের গ্রহের বায়ুমণ্ডলের অবস্থা সম্পর্কে হাবল আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। হাবলের অনুসন্ধানগুলি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছে। 

হাবল টেলিস্কোপ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সারমর্ম আকারে আপানাদের সামনে তুলে ধরা হোল – 

  • ৪৩.৫ ফিটের হাবল টেলিস্কোপকে ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল স্পেস শাটল ডিস্কভারির সাহায্যে মহাশুন্নে প্রেরন করা হয়। 
  • পরের দিন ২৫ এপ্রিল পৃথিবী থেকে ৩৪০ মেইল বা ৫৪৭ কিলোমিটার দূরে পৃথিবীর নিন্ম কক্ষপথে এটিকে স্থাপন করা হয়।
  • হাবলের গতি প্রতি মিনিটে ২৭০০০ কিলোমিটার এবং পৃথিবীকে ১ বার পরিভ্রমণ করতে এর ৯৫ মিনিট সময় লাগে। 
  • হাবলের প্রাইমারি মিররের ডায়ামিটার ৯৪.৫ ইঞ্চি বা ২.৪ মিটার এবং এর সেকেন্ডারি মিররের ডায়ামিটার ১২ ইঞ্চি। 
  • হাবল প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫০ গিগাবাইট তথ্য নাসাকে প্রেরণ করে আসছিল। 
  • টেলিস্কোপে সংযুক্ত দুটি ২৫ ফুট সোলার প্যানেলের মাধ্যমে হাবল সূর্য থেকে ৫৫০০ ওয়াট পাওয়ার সংগ্রহ করে থাকে নিজেকে চালনার জন্য।

চলুন হাবল টেলিস্কোপ সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য জেনে নেয়া যাক।

  • ১৯৯০ সালে মিশন শুরু করার পর থেকে হাবল ১৫ লক্ষেরও বেশি পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেছে।
  • হাবলের প্রেরিত ডেটা ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ১৮,০০০ এরও বেশি বৈজ্ঞানিক নথি প্রকাশ করেছেন, এবং এটি এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে উত্পাদনশীল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রগুলির একটি । 
  • হাবল তারা, গ্রহ বা গ্যালাক্সিতে ভ্রমণ করে না। তবে এটি প্রায় 17,000 মাইল (27,000 কিলমটার) গতিতে পৃথিবীতে চারদিকে ঘুরে বেড়ানোর সময় তাদের ছবি তোলে।
  • থেমে জাওয়ার আগে পর্যন্ত হাবল পৃথিবীর কক্ষপথ ধরে ৪ বিলিয়ন মাইল (৬ বিলিয়ন কিলোমিটার) পথ অতিক্রম করেছে।
  • অপটিক্স এবং সংবেদনশীল ডিটেক্টরগুলির সংমিশ্রণের কারণে এবং কোন পারিপার্শ্বিক হস্তক্ষেপ না করার কারণে হাবল পৃথিবী থেকে চাঁদের পৃষ্ঠে রাতের আলো বেশ ভালভাবে দেখতে পারে।
  • হাবল পৃথিবী থেকে ১৩.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষেরও বেশি দুরের ছবি তুলতে সক্ষম। 
  • প্রতি বছর হাবল প্রায় ১০ টেরাবাইট নতুন ডেটা পৃথিবীতে পাঠাতে সক্ষম ছিল। হাবলের প্রেরিত  সংরক্ষণাগারটির আকার বর্তমানে ১৫০ টিবি-র বেশি।
  • মহাকাশে প্রেরনের সময় হাবল টেলিস্কোপের ওজন ছিল প্রায় ২৪,০০০ পাউন্ড বা (১০,৮০০ কেজি)। যদি এটি এখন পৃথিবীতে ফিরে আসে তবে এর ওজন হবে প্রায় ২৭০০০ পাউন্ড (১২,২০০ কেজি) যা আফ্রিকার দুটি বড় হাতির ওজনের সমান।
  • ১৯৯০ সালের ২০ মে হাবল প্রথম ছবিটি তোলে। জার নাম ছিল Star cluster NGC 3532
  • কক্ষপথে স্থাপনের পর থেকে হাবল টেলিস্কোপ সংস্কারের উদ্দেশে ৫টি মিশন পরিচালনা করা হয়। ১৯৯৩,১৯৯৭,১৯৯৯,২০০২ এবং ২০০৯ সালে 
  • ১৯৯০ সালে হাবল টেলিস্কপটি তৈরিতে ব্যায় হয়েছিলো ৪.৭ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে ৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি। 

বন্ধুরা, মহাকাশ গবেষণায় হাবল টেলিস্কোপের অবদান কতটা, সেটা হয়তো ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছেন। বিজ্ঞান যত এগিয়েছে, মানুষ তার জানার আগ্রহগুলোকে তত বেশি পূর্ণতা দিতে পেরেছে। আর এক্ষেত্রে হাবল টেলিস্কোপ, জানার পূর্ণতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুমিকা পালন করেছে। কিন্তু ২০২১ সালের ১৩ জুন, হাবল টেলিস্কোপ, নতুন নির্মিত জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের কাছে মহাকাশের দায়িত্ব দিয়ে তার অবসর ঘোষণা করে। 

Source:-

https://www.nasa.gov/mission_pages/hubble/main/index.html

https://hubblesite.org/

 

 

 

     

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top