উত্তর কোরিয়ার কট্টরপন্থী সরকার ব্যাবস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য একমাত্র দায়ী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, জাপান-অধিকৃত কোরিয়া উপদ্বীপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানে একটি নতুন কমিউনিস্ট সরকার উত্তর কোরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে চলে যায় দক্ষিণ কোরিয়া।
উত্তর কোরিয়া, গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া (ডিপিআরকে) হিসেবে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পেয়েছিল এবং তখন থেকে দেশটি বাকি বিশ্বের কয়েকটি কমিউনিস্ট দেশগুলির মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যা আনুমানিক ২.৫ কোটি, এবং দেশটির আনুমানিক বার্ষিক মাথাপিছু আয় প্রায় ১,৮০০ ডলার।
এটা ভাবা খুব একটা অস্বাভাবিক নয় যে, বর্তমানে উত্তর কোরিয়ায় সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়নকারী সরকার রয়েছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি যারা পর্যবেক্ষণ করে, তাদেরকে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তারপরও কিছু নাগরিক এবং বহিরাগতদের মধ্যে রেডিও যোগাযোগ রয়েছে।
কিছু সাংবাদিক এবং মানবাধিকারকর্মী উত্তর কোরিয়ার একনায়ক সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন নীতি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য বাকি বিশ্বের কাছে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। উত্তর কোরিয়ার সরকার মূলত একটি বংশীয় স্বৈরশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। স্বাধীন হওয়ার প্রথম দিকে, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান কিম ইল-গাওয়া, তারপরে তাঁর পুত্র কিম জং-ইল, এবং বর্তমানে তাঁর নাতি কিম জং-উন।
আমরা অনেকেই উত্তর কোরিয়া দেশটি সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য জানি, কিন্তু দেশটির কট্টরপন্থী সরকার নিজেদের অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয়ই বাকি বিশ্ব থেকে একপ্রকার গোপন রেখেছে। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। চলুন এ বিষয়ে কিছু তথ্য আপনাদেরকে পরিবেশন করা যাক।
সুপ্রিম লিডারদের একচ্ছত্র প্রভাব
যদিও উত্তর কোরিয়াকে সাধারণত একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়, তথাপি এ দেশটিকে একটি সতন্ত্র স্বৈর শাসন পদ্ধতি হিসাবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। উত্তর কোরিয়ার সরকার সাপ্তাহিক কয়েকটি অধিবেশনে “বিপ্লবী গবেষণা কেন্দ্রগুলি” পরিচালনা করে, এমন ৪,৫০,০০০ সদস্যের উপস্থিতিতে, তাদেরকে খুব মারাত্মক কিছু কথা মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কথা গুলো এমন ছিল যে, কিম জং-ইল একজন দেবতার প্রতিনিধিত্বকারী বাক্তি। তাদেরকে একটি গল্প বলা হয়েছিল, সেটা হল কিংবদন্তীতুল্য কোরিয়ান পর্বতের শীর্ষে একটি অলৌকিক জন্মের সাথে সাথে উত্তর কোরিয়ায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় (আসলে এখানে কিম জং-ইল এর বিষয়ে বলা হয়েছিলো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে)।
কিম জং-উন, যিনি বর্তমানে উত্তর কোরিয়া শাসন করছেন, তিনি কোরিয়ার সাধারন জনগণের কাছে নিজেকে “প্রিয় নেতা” হিসাবে একইভাবে এই বিপ্লবী গবেষণা কেন্দ্রগুলিতে অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্পন্ন সর্বোচ্চ নৈতিক সত্তা হিসাবে একটি বর্ণনা দাড় করিয়েছেন।
উত্তর কোরিয়ার সরকার তার নাগরিকদের প্রিয় নেতার প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রকাশকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। “মূল” (হ্যাকসিম কেচুং), “দোদুল্যমান” (টঙ্গিও কেচুং) এবং “বিরোধী” (জোকায়ে কেচুং)। দেশটির বেশিরভাগ সম্পদ “মূল” গোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে।
তবে “বিরোধী” অংশে সাধারণত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্ত সদস্য এবং সেইসাথে রাষ্ট্রের শত্রুদের বংশধরদের অন্তর্ভুক্ত করে, কর্মসংস্থান থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এ শ্রেণী জনগন সবসময়ই নির্যাতিত এবং অর্থাভাবের কারনে বেশিরভাগ সময়ই অনাহারের শিকার হয়।
আরও পড়ুনঃ- কিম জং-উন, ঊত্তর কোরিয়ার মহা প্রতাপশালী একনায়ক (জীবন ও দর্শন)।
দেশপ্রেমে বল প্রয়োগ করা
উত্তর কোরিয়ার সরকার জনগণের সুরক্ষা মন্ত্রনার মাধ্যমে সরকারের প্রতি একপ্রকার বাধ্যতামূলক আনুগত্য প্রয়োগে বাধ্য করে। এর মাধ্যমে সাধারন নাগরিকদের এক ধরণের বার্তা দেয়া হয় যে, প্রতিটি নাগরিকের পরিবারের সদস্যরা একে অপরের উপর নজর রাখবে। যদি কেউ সরকারের পক্ষে সমালোচনাযোগ্য কিছু বলে, তবে উত্তর কোরিয়ার ১০ টি নৃশংস নির্যাতন শিবিরের একটিতে সে বাক্তিকে পাঠানো হয়।
যেখানে অপেক্ষা করে আছে নির্যাতন, কারাভোগ বা মৃত্যুদন্ডের মতো ভয়ানক শাস্তি।
উত্তর কোরিয়া বিশ্বের অন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্র। দেশটির সরকার তার নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ, সমিতি এবং ধর্ম সহ সকল নাগরিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে থাকে। দেশটির সরকার সমস্ত সংগঠিত রাজনৈতিক বিরোধী, স্বাধীন মিডিয়া, সুশীল সমাজ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে নিষিদ্ধ করেছে।
সরকারের প্রতি ভীতি প্রদর্শন এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সরকার নিয়মিতভাবে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও শাস্তি, হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন, জোরপূর্বক শ্রম এবং অতি সাধারন অপরাধের জন্য ফাঁসি কার্যকর করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, জনসাধারণকে চীনে ভ্রমণ এবং অননুমোদিত আন্তঃসীমায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নিষেধাজ্ঞাগুলি আরও কঠোর করেছে এবং উত্তর কোরিয়ার বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করার জন্য শাস্তির বিধান সম্বলিত আইন পাস করেছে।
সমস্ত রেডিও এবং টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠানের খুতবাগুলিতে প্রিয় নেতার প্রশংসা করার দিকে গুরুত্ব দিয়েছে। যদি কেউ যে কোনও উপায়ে বিদেশীদের সাথে যোগাযোগ করে বা বিদেশী রেডিও শুনে, তবে সে (কয়েকটি রেডিও চ্যানেল উত্তর কোরিয়ায় অনুমোদিত) উপরে বর্ণিত যেকোন শাস্তির ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
এখানকার নাগরিকদের উত্তর কোরিয়ার বাইরে ভ্রমণও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এর জন্য মৃত্যদন্ডের মতো শাস্তি বহন করতে হতে পারে।
একটি সামরিক রাষ্ট্র
কম জনসংখ্যা এবং সল্প বাজেট সত্ত্বেও, উত্তর কোরিয়ান সরকার সিরিয়াসলি নিজেদেরকে সামরিকীকরণের দিকে অনেক আগেই ধাবিত করেছে। তারা দাবি করেছে যে তাদের ১৩ লক্ষ্য সৈন্যের একটি বিশাল সেনাবাহিনী রয়েছে (যা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম) এবং এছাড়া তারা একটি সমৃদ্ধ সামরিক গবেষণা কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন এবং দুরপাল্লার মিসাইল বাবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
উত্তর কোরিয়ান সরকার উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে বিশাল আর্টিলারি ব্যাটেলিয়ন মোতায়েন রেখেছে। যা আমেরিকা বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে কোন প্রকার উস্কানিতে কোন একটি দ্বন্দ্বের সুত্রপাত হলে দক্ষিণ কোরিয়ায় দ্রুত হামলার ঘটনা ঘটাতে নকশাকৃত।
আরও পড়ুনঃ- কোরীয় যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়া যেভাবে জড়িয়েছিল?
গণ দুর্ভিক্ষ এবং গ্লোবাল ব্ল্যাকমেল
নব্বইয়ের দশকে উত্তর কোরিয়ায় প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। সে সময় উত্তর কোরিয়ায় কোন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না হলেও, দেশটির সরকার সাধারন জনগণের মাঝে খাদ্যশস্য প্রদান বন্ধ করে দেয়, ফলস্বরূপ আরও বেশ কয়েক লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল।
এ সকল ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও প্রিয় নেতার কাছে এটি উদ্বেগজনক বলে মনে হয় নি। শাসক শ্রেণীর মধ্যে যারা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক তারা ব্যতিত অন্য সাধারন উত্তর কোরিয়ান নাগরিকদের প্রায় সবাই সর্বজনীন অপুষ্টির স্বীকার। সাধারন একটা জরীপে দেখা গিয়েছে উত্তর কোরিয়ার ৭ বছর বয়সের শিশুদের গড় উচ্চতা দক্ষিণ কোরিয়ার সমবয়সীদের তুলনায় আট ইঞ্চি কম।
আইনের কোনও বালাই নেই
উত্তর কোরিয়া সরকার ১০ টি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প পরিচালনা করে থাকে। ধারণা করা হয়, সেখানে ২,০০,০০০ থেকে ২,৫০,০০০ বন্দী রয়েছে। ক্যাম্প গুলোর পরিস্থিতি প্রচন্ড ভয়াবহ এবং এখানকার বার্ষিক হতাহতের হার ২৫% এর বেশি হিসাবে অনুমান করা হয়। উত্তর কোরিয়া সরকারের ইচ্ছামতো বন্দিদের কারাবরণ, নির্যাতন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
আইনই প্রক্রিয়ার কোন কিছুই এখানে পরিলক্ষিত হয় না। বিশেষ করে সরকারী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা উত্তর কোরিয়ার একটি সাধারণ বিষয়।
গবেষণা পূর্বাভাস
বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি বর্তমানে আন্তর্জাতিক কোন পদক্ষেপের দ্বারা সমাধান করা সম্ভব নয়। মার্কিন মানবাধিকার কমিটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে নিন্দা করলেও, কোনও লাভ হয়নি।
কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও উত্তর কোরিয়া সরকার ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে যে, তারা এগুলো গায়ে মাখে না। তাদের নাগরিক বাঁচল কি মারা গেল তাতে উত্তর কোরিয়ান নেতাদের যায় আসে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামরিক পদক্ষেপ এখানে কার্যকর নয়। এর মূল কারণ হ’ল উত্তর কোরিয়ার সরকার কোন ভাবে আক্রান্ত হলে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েক মিলিয়ন সাধারন নাগরিক হতাহত হতে পারে।
উত্তর কোরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে এবং তারা জৈবিক অস্ত্রের অধিকারীও হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ এ সকল হুমকিকে আরও বাড়িয়েছে।
রাসায়নিক, জৈবিক বা পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছতে পারে খুব সহজেই। এগুলো জাপানে পৌঁছাতে পারে এবং বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানতে পারে কিনা সে বিষয়ে সম্ভাব্য উৎক্ষেপণের জন্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
অনেক উত্তর কোরিয়ার নাগরিক বিদেশী মিডিয়া এবং বিদেশী রেডিও স্টেশনগুলিতে অ্যাক্সেস পেয়েছে, তবে তাদের প্রচারকে একপ্রকার প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
২০১২ সালে কিম জং-ইলের মৃত্যুর ফলে কিম জং উনের নেতৃত্বে একটি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের সূচনা হয়েছিল। ২০১৮ সালে, কিম উত্তরের পারমাণবিক অস্ত্র বিকাশকে সম্পূর্ণ সফল হিসেবে ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক অগ্রাধিকার হিসাবে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘোষণা করেছে এবং কূটনৈতিক ব্যস্ততা বাড়িয়েছে। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি মুন জা-ইন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে সাক্ষাত করেছেন।
এতদসত্তেও, উত্তর কোরিয়ার সাধারন জনগণের জন্য কোন ভালো বার্তা যে নেই সেটা স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়। উত্তর কোরিয়ার কঠোর গোপনীয়তার ফলে, আমরা ভালো ভাবে সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব একটা বেশি জানতে পারি না , কিন্তু এটা খুব ভালভাবেই অনুমান করা যায় যে, সেখানকার মানুষের স্বাধীনতা কতটা ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে।
তথ্যসূত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Human_rights_in_North_Korea
https://www.bbc.com/news/world-asia-44234505
https://www.hrw.org/asia/north-korea
https://www.hrw.org/news/2018/06/05/human-rights-north-korea