মা দিবস (Mother’s Day) হল মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর একটি বিশেষ দিন। যে দিনটিতে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছুটি ঘোষণা করা হয়, এবং মা দের উদ্দেশ্যে সম্মান জ্ঞাপনের লক্ষে সারা বিশ্বে বিভিন্ন রূপে দিবসটি পালিত হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার (১০ মে) মা দিবস পালনের জন্য নির্ধারিত হয়েছে।
১৯০৮ সালে মা দিবসের প্রথম অবতারনা হয় আনা জার্ভিস এর হাত ধরে। ১৯১৪ সালে এ দিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারী ছুটিতে পরিণত হয়েছিল। অ্যানা জার্ভিস যদিও পরবর্তীতে এই ছুটির বাণিজ্যিকী করণের জন্য নিন্দা প্রকাশ করেছিলেন।
তবে ১৯১৪ পরবর্তী সময়ে মা দিবস পালনের অগ্রযাত্রা আর থামানো যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। পৃথিবীর সকল মায়েদের সম্মান জানানোর জন্য বাংলাদেশেও এ দিনটি পালিত হয়।
পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি এ দিনটি বিভিন্ন ভাবে পালন করে, তবে উৎযাপনে ভিন্নতা থাকলেও মাদার্স ডেতে ঐতিহ্যগতভাবে ফুল, কার্ড এবং অন্যান্য উপহারের সাথে মাকে ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানানো হয়।
মা দিবস পালনের ইতিহাস
মা এবং মাতৃত্ব কালের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উৎযাপনের রীতি শুরু হয়েছিলো, প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের থেকে। মাতৃদেবী রিয়া এবং সাইবেলের সম্মানে এসব উৎসব পালন করা শুরু করেছিল তারা। তবে মা দিবসের সবচেয়ে স্পষ্ট এবং আধুনিক ধারণার সূচনা ঘটায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়। তারা প্রথমে একে “মাদারিং সানডে” নামে পালন করতো।
যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের কিছু অংশে ঐতিহ্যবাহী এই উৎযাপনটি মে মাসের চতুর্থ রবিবারে পালিত হতো এবং এ সময় অনেকেই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাদের বাড়ির আশেপাশের প্রধান কোন গির্জায় যেতো। সময়ের সাথে সাথে ‘মাদারিং সানডে’র ঐতিহ্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ ছুটিতে রুপান্তরিত হয়েছিল। শিশুরা তাদের মাকে ফুল এবং অন্যান্য গিফট কার্ড দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে দিনটি পালন করে থাকে।
অ্যান রিভেস জার্ভিস এবং জুলিয়া ওয়ার্ড হাও এর মা দিবস পালনের ইতিহাস
আমেরিকার ইতিহাস ঘাঁটলে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মা দিবস (Mother’s Day) পালনের কিছু ইতিহাস দেখতে পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে মাদার্স ডে’র উত্পত্তি হয়েছিলো গৃহযুদ্ধেরও আগে। এ সময় পশ্চিম ভার্জিনিয়ার অ্যান রিভস জার্ভিস নামে একজন মহিলা, স্থানীয় মহিলারা কীভাবে তাদের সন্তানের যত্ন নিতে পারে সে বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য “মাদার্স ডে ওয়ার্ক ক্লাব ” নামে কিছু প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করতে সহায়তা করেছিলেন।
এই ক্লাবগুলি পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেশের একটি অঞ্চলে একত্রিত হতে শুরু করে। ১৮৬৮ সালে জার্ভিস “মাদার্স বন্ধুত্ব দিবস ” (“Mothers’ Friendship Day,”) এর আয়োজন করেছিলেন। যেখানে প্রাক্তন মায়েরা ইউনিয়ন এবং কনফেডারেট সৈন্যদের সাথে মিলিত হয়েছিল।
অ্যান রিভেস জার্ভিস ছাড়াও মাদার্স ডে’ পালনের ক্ষেত্রে জুলিয়া ওয়ার্ড হাও নামে আর এক ব্যাক্তির নাম পাওয়া যায়। ১৮৭০ সালে ওয়ার্ড হাও “মাদার্স ডে প্রোক্লেমেশন” নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যেখানে কর্মের আহ্বান এর পাশাপাশি মায়েদের বিশ্ব শান্তির প্রচারে একত্রিত হতে বলা হয়েছিলো। ১৮৭৩ সালে হাও “মায়েদের শান্তির দিন” (Mother’s Peace Day) নামে প্রতি ২ জুন তারিখে দিন টি পালন করা শুরু করেছিলেন।
আন্না জার্ভিস (Anna Jarvis) যেভাবে দিনটি পালন শুরু করেছিলেন
মা দিবস (Mother’s Day) পালনের আধুনিক ইতিহাস ঘাটলে প্রথমে যে ব্যাক্তির নাম আসে, তিনি হলেন আন্না জার্ভিস (Anna Jarvis)। ১৯০০ শতকের প্রথম দিকে তিনি এ দিবসটি পালনের জন্য মে মাসের ২য় রবিবারকে বেঁছে নিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালন করা শুরু হয়েছিল। আন্না জার্ভিস (Anna Jarvis) এর মায়ের নাম ছিল অ্যান রিভেস জার্ভিস।
১৯০৫ সালে অ্যান রিভেস জার্ভিসের মৃত্যুর পরে, আন্না জার্ভিস, মা বাচ্চাদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করে সেটাকে সম্মান জানানোর উপায় হিসাবে মা দিবস (Mother’s Day) এর ধারণাটি প্রথম নিয়ে এসেছিলেন।
জন ওয়ানামাকের (John Wanamaker) নামে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া ডিপার্টমেন্ট স্টোরের এক মালিকের আর্থিক সহায়তায়, তিনি ১৯০৮ সালের মে মাসে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনের একটি মেথোডিস্ট গির্জায় প্রথম মা দিবস (Mother’s Day) উদযাপনের আয়োজন করেছিলেন। সেই একই দিনে ফিলাডেলফিয়ার ওয়ানামেকারের এক খুচরা দোকানে হাজার হাজার মানুষ মা দিবসের (Mother’s Day) অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল।
জার্ভিস, তার প্রথম মা দিবস (Mother’s Day) পালনের সাফল্যের পরে, তিনি অবিবাহিত মহিলা এবং যারা নিঃসন্তান তাদের কিছু গুরুত্ব পূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি এ দিনটিকে ছুটি হিসেবে ঘোষণা করার জন্য বিভিন্ন প্রচেস্টা শুরু করেছিলেন।
আমেরিকার ছুটির দিনগুলি ছিল সাধারণত পুরুষদের সাফল্যের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। এ যুক্তি দিয়ে তিনি মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য বছরের একটি দিনকে ছুটি ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ লক্ষে বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের কাছে চিঠি প্রেরণ করেছিলেন তিনি।
১৯১২ সালের মধ্যে অনেক রাজ্য, শহর ও গীর্জায় মাদার্স ডে’কে বার্ষিক ছুটি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিলো। জার্ভিস তার প্রচারে সহায়তা হবে, এই ভেবে “মা দিবস আন্তর্জাতিক সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯১৪ সালে রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস (Mother’s Day) হিসেবে ঘোষণা করার জন্য করার জন্য একটি বিলে স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে জার্ভিসকে তার অধ্যবসায়ের প্রতিদান দেওয়া হয়েছিল।
মা দিবস (Mother’s Day) এর বাণিজ্যিকি করনে জার্ভিসের ক্ষোভ
আন্না জার্ভিস মা দিবসটি, প্রত্যেক মা এবং তার পরিবারের মধ্যে ব্যক্তিগত উদযাপনের দিন হিসাবে ধারণ করেছিলেন। তবে মা দিবস (Mother’s Day) জাতীয় ছুটিতে পরিণত হওয়ার পরে, বিভিন্ন ফুল বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান, কার্ড প্রস্তুতকারী সংস্থা এবং অন্যান্য ব্যাবসায়িরা এর জনপ্রিয়তার মূল্য বুঝতে পেরে ব্যাবসায়িক দিক দিয়ে দিনটিকে বিবেচনা করতে শুরু করেন।
যদিও জারভিস শুরুতে মা দিবসের প্রচারনা বাড়াতে ফুল শিল্পের প্রসারে কাজ করেছিলেন। তবে ১৯২০ সালের দিকে দিনটিকে যেভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা শুরু হয়েছিল তা নিয়ে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এর নিন্দা জানান এবং লোকদের মা দিবসের জন্য ফুল, কার্ড এবং চকোলেট না কেনার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মিষ্টি বিক্রেতা, ফুলওয়ালা এবং বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গিয়ে জার্ভিস মা দিবস কে পুঁজি করে যারা ব্যাবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি “মাদার্স ডে” নাম ব্যাবহারকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বহু মামলা দায়ের করেছিলেন। অবাক করা বিষয় হল শেষ পর্যন্ত তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পদের বেশিরভাগই আইনী ফি দিতে ব্যয় করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে তার মৃত্যুর সময় তার সৃষ্ট মা দিবস (Mother’s Day) র ছুটিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছিলেন তিনি এবং আমেরিকান ক্যালেন্ডার থেকে দিবসটি বাদ দেয়ার জন্য সরকারের নিকট তদবির করেছিলেন।
বিশ্বজুড়ে মা দিবস যেভাবে পালিত হয়
বর্তমানে মা দিবস (Mother’s Day) সারা বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে দিনটিকে ভিন্ন ভাবে পালন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, থাইল্যান্ডে প্রতি বছর আগস্ট মাসে বর্তমান রানী সিরিকিতের জন্মদিনটিকে মাদার্স ডে হিসেবে পালন করা হয়।
মা দিবসের অনুষ্ঠান ইথিওপিয়ায় আরেকটু ভিন্নভাবে পালন করা হয়ে থাকে। সেখানকার পরিবারগুলো দিবসটি পালনের দিনে গানের আয়োজন করে এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানাতে বহু-দিনের উৎযাপনের রীতি হিসেবে বড় ভোজের আয়োজন করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মা এবং মাত্স্থানিয় মহিলাদেরকে উপহার এবং ফুল দিয়ে সম্মান জানানোর মাধ্যমে মা দিবস (Mother’s Day) পালন অব্যাহত রয়েছে। এ দিবসটি আমেরিকান জনগণের জন্য অন্যতম বৃহত্তম একটি ছুটির দিনে পরিণত হয়েছে। পরিবার সামলানো, রান্নাবান্না এবং অন্যান্য গৃহস্থালীর কাজ থেকে মায়েদের ছুটি দেওয়ার মাধ্যমে পরিবারগুলি দিবসটি উদযাপন করে থাকে।
এছাড়া বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মায়েদের শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানানোর জন্য মে মাসের ২য় রবিবার মা দিবস (Mother’s Day) পালন করে।
অনেক সময়, মা দিবস রাজনৈতিক বা নারীবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্যও অনেকেই পালন করে। ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্ত্রী কোরেট্টা স্কট কিং, সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের সমর্থনে একটি মার্চ আয়োজন করতে মাদার্স ডে’কে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭০ এর দশকে মহিলাদের সংগঠনগুলো শিশুদের যত্নের জন্য মা দিবসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিল।
তবে মা দিবস যে যেভাবেই পালন করুক না কেন, দিনটির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, এবং তাৎপর্য অনেক। প্রতিটি সন্তানের তাদের মা বাবার প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে। অনেকেই আছেন যারা সে কর্তব্য গুলোকে অস্বীকার এবং অবহেলা করেন। মা দিবস সেই সকল মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়ার জন্য একটি বিশেষ দিন হতে পারে। সকল মায়েদের প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা রইল।
তথ্যসূত্রঃ- https://www.history.com/topics/holidays/mothers-day
https://www.britannica.com/topic/Mothers-Day?utm_medium=mendel-homepage&utm_source=4up&utm_campaign=4up-1&utm_term=20200507
https://en.wikipedia.org/wiki/Mother%27s_Day