“সমুদ্র” সে তো এক বিশাল ব্যাপার, আর যদি গভীর সমুদ্র (Deep sea) হয় তবে সেটা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর! আমরা জানি মহাসাগরগুলো পৃথিবী পৃষ্ঠের মোট আয়তনের ৭০ ভাগ এলাকা দখল করে রয়েছে। আর এ বিশাল বিস্তৃত জলরাশি প্রতিনিয়তই মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে তার অজানা রহস্যকে উতঘাটন করার জন্য। এবং মানুষ সে ডাকে সাড়াও দিয়েছে যথারীতি।
প্রতিদিনই পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে নতুন নতুন সামুদ্রিক অভিজান পরিচালিত হচ্ছে, নতুন কিছু আবিস্কারের আশায় গভীর সমুদ্রে ডুব দিচ্ছে মানুষ এবং নতুন কিছু জানতে পারছে, সেই সাথে জানাতেও পারছে সারা বিশ্বকে। কিন্তু সমুদ্র এতো বিশাল, বিস্তৃত এবং গভীর যে, আজও তাদের গভীরতা অনেকাংশে অনাবিষ্কৃত রয়ে গিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এটা নিশ্চিত ভাবেই বলেছেন, এখনো গভীর সমুদ্রের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ এলাকা মানুষের কাছে রহস্যই রয়ে গেছে। গভীর সমুদ্র এ গ্রহের চূড়ান্ত সীমানা, যেখানে পৌঁছানো বা এর রহস্য উতঘাটন করা মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। আমরা আজ গভীর সমুদ্র অভিজান নিয়ে নিচের আলোচনায় কিছু তথ্য তুলে ধরার চেস্টা করেছি।
গভীর সমুদ্র বলতে আসলে আমরা কি বুঝি?
“গভীর সমুদ্র” (Deep sea) বিশয়টিকে খুবই সাধারন একটি শব্দ শোনালেও অনেকেই এটাকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার চেস্টা করেছেন। যদি আপনি জেলেদের কথা বলেন তো, তারা গভীর সমুদ্র বলতে অগভীর মহাদেশীয় সমুদ্র সীমাকেই বোঝায়।
অর্থাৎ জেলেরা তাদের নৌযানে চড়ে যত সমুদ্রের দূরত্ব পার করে তারা ভাবে এটাই সবচেয়ে বেশি গভীর সমুদ্র।
বিজ্ঞানীদের কাছে, গভীর সমুদ্র বলতে সমুদ্রের নিম্নতম অংশকে বোঝায়, অর্থাৎ যেটা থার্মোকলিনের নীচের অংশ ( যেখানে সূর্যের আলো থেকে উত্তাপ এবং শীতল করণের প্রভাব বন্ধ হয়ে যায় এমন স্তর)। এটি সাধারণত সমুদ্রের এক হাজার ফ্যাদম বা ১,৮০০ মিটার গভীর অংশকে বোঝানো হয়।
গভীর সমুদ্র অভিযানের ইতিহাস

গভীর সমুদ্র সবসময়ই অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে এবং অত্যন্ত শীতল ( এর ৩০০০ মিটার নিচের তাপমাত্রা ০ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে)। সমুদ্রের যতই গভীরে যাওয়া যায় এর পানির চাপ ততই বাড়তে থাকে। ১০০০ মিটার নিচে পানির চপের পরিমান ১৫,৭৫০ পিএসাই, যা বায়ু মণ্ডলের চাপের তুলনায় এক হাজার গুণ বেশি।
রোমান বিজ্ঞানি প্লিনির সময় থেকে উনিশ শতকের শেষ অবধি মানুষ বিশ্বাস করত গভীর সমুদ্র একটি প্রাণহীন উর্বর ভূমি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অনুসন্ধানের পরে গভীর সমুদ্রকে গ্রহের বৃহত্তম আবাসস্থল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এই শীতল, অন্ধকার, চাপযুক্ত পরিবেশটি সম্পর্কে কিছু বিশেষায়িত সরঞ্জামের মাধ্যমে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা গভীর সমুদ্রের বসবাসরত প্রাণীদের সম্পর্কে এমন ধারনাই তৈরি করেছে।
গভীর সমুদ্র গবেষণা বা অভিযান সম্পর্কে এ গ্রহের মানুষ সবসময়ই অত্যন্ত কৌতুহুলি, এবং প্রতিনিয়ত তারা গভীর সমুদ্র অনুসন্ধানে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। গভীর সমুদ্র অনুসন্ধানের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিচে তুলে ধরা হল।
১৫২১ সালে ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান নামে এক পর্তুগীজ অভিযাত্রী প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা পরিমাপ করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ২,৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি লাইন ব্যাবহার করেছিলেন। তবে এ ভারি ওজনের লাইনটি সমুদ্রের নীচে স্পর্শ করেনি।
এর পরের অভিযানটি পরিচালনা করেন স্যার জন রস। ১৮১৮ সালে সমুদ্রের ২ হাজার মিটার (৬,৫৫০ ফুট) গভীর থেকে তিনি জেলিফিশ ধরেন, যা গভীর সমুদ্রে যে জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে তার প্রথম প্রমাণ সামনে নিয়ে আসে।
এরপর ১৮৪০ সালে স্যার জেমস ক্লার্ক রস, বেলি সাউন্ডিং মেশিন নামে এক ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করে সমুদ্রের ৩,৭০০ মিটার (১২,১৩৯ ফুট) গভীরতায় পৌঁছেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সমুদ্রের গভীর তলদেশ স্পর্শ করা।
রসের আবিষ্কার সত্ত্বেও, ১৮৪২ সালে অ্যাডওয়ার্ড ফোর্বস অ্যাবিসাস তার প্রদত্ত থিওরিতে একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে, গভীর সমুদ্রে মৃত্যুর সাথে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায় এবং জীবন ৫৫০ মিটার (১,৮০০ ফুট) এর চেয়ে বেশি গভীরতায় বেঁচে থাকতে পারে না।
১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত চার্লস ওয়াইভিলি থমসনের নেতৃত্বে এইচএমএস চ্যালেঞ্জার নামে একটি যান প্রথম গভীর সমুদ্র অনুসন্ধানের জন্য অভিযান পরিচালনা করে। থমসনের নেতৃত্বাধীন এ দলটি সমুদ্র তলের কাছে জীবনের সাথে অনন্যভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া অনেক নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে।
১৯৩০ সালে উইলিয়াম বিবি এবং ওটিস বার্টন নামে দুই জন সমুদ্র ভ্রমণকারী, প্রথম মানুষ হিসেবে গভীর সমুদ্র অভিযাত্রী হিসেবে ইতিহাসে স্থান পান। তাদের ইস্পাতের তৈরি বাথিস্ফিয়ারের (গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানের জন্য নির্মিত এক প্রকার সাবমারসিবল) মধ্যে, তারা চিংড়ি এবং জেলিফিশ দেখতে পান।
১৯৩৪ সালে ওটিস বার্টন ১,৩৭০ মিটার (০.৮৫ মাইল) ডাইভ করে এক নতুন গভীরতায় পৌঁছে যান এবং ডাইভিং ইতিহাসে একটি নতুন মানব ডাইভিং রেকর্ড তৈরি করেন।
১৯৫৬ সালে ক্যালিপসো নামে একজন ব্যাক্তি “ দ্য সাইলেন্ট ওয়ার্ল্ড “ নামে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন, যেখানে তিনি গভীর সমুদ্রের সৌন্দর্য এবং জীবন সম্পর্কে মানুষকে দেখিয়েছিলেন।
১৯৬০ সালে জ্যাক পিকার্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভি লেফটেন্যান্ট ডোনাল্ড ওয়ালশ, গভীর সমুদ্র অনুসন্ধানে নির্মিত যান ট্রিস্টে(Trieste) তে চড়ে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের (গভীরিরতা ১০,৭৪০মিটার / ৬.৬৭ মাইল) চ্যালেঞ্জার ডিপের তলদেশে নেমেছিলেন। স্টার ফিশ ছাড়াও তারা নানা রকমের অজানা প্রাণীর দেখা সেখানে পান। তারা বিশ্বাসই করেননি এত গভীরে কোন প্রাণী বাস করতে পারে।
১৯৯৫ সালে জিওস্যাট স্যাটেলাইট রাডার, সাগরের তলদেশের তথ্যগুলিকে বিশ্বব্যাপী ম্যাপিংয়ের জন্য অনুমতি দেয়া হয় ।
২০১২ সালে বিখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা জেমস ক্যামেরন মারিয়ানা ট্রেঞ্চে/চ্যালেঞ্জার ডিপের নীচে প্রথম এককভাবে নেমেছিলেন। এবং এটা আশা করা হয়েছিলো, প্রথমবারের মতো সমুদ্রের নীচে চিত্রগ্রহণ ও নমুনা তৈরি করার প্রয়াস পাওয়া যাবে।
২০১৮ সালে ভিক্টর ভেস্কোভো দ্বারা চালিত ডিএসভি লিমিটিং ফ্যাক্টর, নামের একটি যান আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরতম পয়েন্টে প্রথম মিশন সমাপ্ত করে, এটি সমুদ্র পৃষ্ঠের ৮,৩৭৫ মিটার (২৭,৪৭৭ ফুট) গভীরে ডুব দিয়ে পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্চের গোরায় পৌঁছেছিলেন।
আধুনিক সময়ে পরিচালিত বিভিন্ন সমীক্ষা, গভীর সমুদ্রের ভূগোল এবং জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে অনেক প্রসারিত করেছে। এখানকার বিভিন্ন প্রাণীর প্রজাতিগুলি আবিষ্কার এবং এদের প্রভাব সম্পর্কে মানুষ প্রতিনিয়ত অনুসন্ধান করে চলেছে।
অনুসন্ধানের জন্য নতুন যন্ত্র ও প্রযুক্তির প্রয়োজন। যদিও স্থানটি শীতল, এবং প্রচন্ড চাপযুক্ত, তথাপি এ গভীর অন্ধকারকে জয় করার প্রয়াস চলছেই। এবং অতীতেও এ ধারা বেশ সচল ছিল।
অষ্টম শতাব্দীতে ভাইকিংস দ্বারা পানির গভীরতা পরিমাপের মাধ্যমে শুরু হয় এ কার্যক্রম, এরপর উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দড়ির পরিবর্তে তার ব্যবহার করা, দূরত্ব নির্ধারণের জন্য প্রতিধ্বনি পদ্ধতি আবিষ্কার করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
গভীর সমুদ্রে মানুষ এবং যন্ত্রের অভিযান

মানুষ অদ্যাবধি গভীর সমুদ্রে যেসব অনুসন্ধান পরিচালনা করেছেন, তার সবগুলিতেই যন্ত্রের সংশ্লেষ ছিল। বলা যায় আধুনিক অনুসন্ধান মূলত রোবোটিক সিস্টেমের উপরই নির্ভর করে। দূর থেকে চালিত এ সকল যানবাহনকে বলা হয় (আরওভি)। আরওভিতে সাধারণত ক্যামেরা, ম্যানিপুলেটর অস্ত্র, সোনার সরঞ্জাম এবং নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস সংযুক্ত থাকে।
সমুদ্রের গভীরতম স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,৯৯৪ মিটার (৩৬,০৭০ ফুট বা প্রায় ৭ মাইল) নীচে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের চ্যালেঞ্জার ডিপ। এ পর্যন্ত তিন জন অভিযাত্রী চ্যালেঞ্জার ডিপের গভীরতা পরিদর্শন করেছেন।
চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন ২০১২ সালে একক নিমজ্জন ডাইভের মাধ্যমে রেকর্ড ৩৫,৭৫৬ ফুট গভীরতায় পৌঁছেছিলেন। এ স্থানটির গভীরতা এতটাই যে, মাউন্ট এভারেস্ট কে যদি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অভ্যন্তরে বসিয়ে দেয়া হয়, তবে এটি এখানে ফিট হওয়ার পরেও তার উপরে এক মাইল অতিরিক্ত জায়গা থাকবে।
যদিও মানব অনুসন্ধান এখনও ঘটে, বেশিরভাগ আধুনিক আবিষ্কারগুলি রোবট এবং সেন্সরগুলির ডেটা ব্যবহার করে করা হয়। ডীপ সি অনুসন্ধানের নামে অনেক অভিযান পরিচালিত হয়েছে, এবং অনেক সফলতাও মিলেছে একথা সত্যি কিন্তু মানুষ আসলে কতটুকু সফল?
তথ্য সুত্রঃ- https://www.thoughtco.com/deep-sea-exploration-4161315
https://en.wikipedia.org/wiki/Deep-sea_exploration