১৯৪৫ সালের ২৪ এপ্রিল ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিনগুলিতে উত্তর ইতালির ছোট্ট গিওলিনো মে মেজেগ্রা গ্রামে যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত ইতালিয়ান ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসক বেনিটো মুসোলিনি (Benito Mussolini) ।
প্রিয় পাঠক, ঠিক এখানেই মুসলিনির মৃত্যু (Death of Benito Mussolini) হয় এবং সমাপ্তি ঘটে ইতালির ইতিহাসের এক ঘটনা বহুল অধ্যায়ের। তার মৃত্যু নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি, হয়নি কম বিতর্ক।
অনেক বিভ্রান্তির পরে মুসলিনির মৃত্যুকে অবশ্য একটা পর্যায়ে এনে দাড় করানো গিয়েছে। নিচের লেখাগুলো থেকে আমরা সেটাই আজ জানার চেস্টা করবো।
মুসোলিনির ক্ষমতার গতিহীনতা
![March_on_Rome](https://www.factsw.com/wp-content/uploads/2020/01/March_on_Rome_1922_-_Mussolini.jpg)
১৯৪০ সালে, মুসোলিনি তার দেশ ইতালিকে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিয়ে গেলেও বিভিন্ন দিক থেকে তিনি শীঘ্রই সামরিক ব্যর্থতার মুখোমুখি হন। হিটলারের সমকক্ষতা অর্জন করার মানুশিকতা তার মধ্যে প্রবল ছিল। এহেন মানুশিকতা বাস্তবায়নের জন্য তিনি বিশেষকরে আফ্রিকাতে বেশ কিছু সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং ব্যার্থ হন।
১৯৪৩ সালে মিত্রবাহিনী রোমে বোমা বর্ষণ শুরু করলে ইতালীর ফ্যাসিস্ট কাউন্সিলের সদস্যরা মুসোলিনির বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তাকে আটক করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
এ অবস্থায়, হিটলার তাকে উদ্ধার করে উত্তর ইতালির ক্ষমতা প্রদান করেন। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, এতেকরে তিনি জার্মান সরকারের পুতুল রাষ্ট্রনেতা হয়ে ওঠেন এবং দক্ষিণ ইতালির বিপক্ষদের সাথে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হন।
মুসোলিনির পালায়ন এবং মৃত্যু
১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে মিত্রবাহিনী উত্তর ইতালির সর্বশেষ জার্মান প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলে এবং তখন এখানকার শহরগুলিতে তার নিজের পার্টির সদস্যদের দ্বারা সাধারণ অভ্যুত্থানের ফলে মুসোলিনির পরিস্থিতি কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
২৫ এপ্রিল তিনি মিলান থেকে পালিয়ে যান, এবং সুইস সীমান্ত দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল মুসোলিনি তাঁর উপপত্নী ক্লেরেট্টা পেটাকি এবং অন্যান্য ফ্যাসিবাদী নেতাদের সাথে, লেক কোমোর উত্তর পশ্চিম তীরে দোঙ্গো গ্রামের কাছে একটি জার্মান কনভয়ে ভ্রমণ করছিলেন।
সে সময়, পিয়র লুইজি বেলিনি ডেলি স্টেল এবং আরবানো লাজারোর নেতৃত্বে একদল স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা এই কনভয়ে আক্রমণ করে এবং এটি থামাতে বাধ্য করে। সুরক্ষার দায়িত্তে থাকা জার্মানরা কনভয়ের সকলকে ইতালিয়দের হাতে তুলে দেয়ার বিনিময়ে তাদের মুক্ত করে নেয়।
পারটিশান্সরা কনভয়ে মুসলিনিকে খুঁজে পায় এবং গ্রেপ্তার করে তাকে ডঙ্গোতে নিয়ে যায়, যেখানে তিনি স্থানীয় ব্যারাকে রাতের কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন।
কমিউনিস্টরা মুসোলিনি এবং পেটাকিকে বাদ দিয়ে, তাদের মধ্যে সর্বাধিক ষোলজনকে পরের দিন ডঙ্গোতে গুলি করা হয় এবং এরপর আরও দশজনকে পরপর হত্যা করা হয়। সব শেষে মুসোলিনি এবং তার উপপত্নী ক্লেরেট্টা পেটাকির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ধারণা করা হয়, অ্যাডলফ হিটলারের আত্মহত্যার দু’দিন আগের বিকেলে মুসোলিনি এবং পেটাকিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
মৃত্যুর পরে মুসোলিনি
![মুসলিনির ঝুলন্ত মৃত দেহ](https://www.factsw.com/wp-content/uploads/2020/01/Mussolini_e_Petacci_a_Piazzale_Loreto_1945.jpg)
মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরে মুসোলিনি এবং পেটাকির মৃতদেহ মিলানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একটি বৃহত বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে লাঞ্ছিত ও শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হওয়ার জন্য পিয়াসালে লরেটো শহরতলির একটি চত্বরে রেখে দেয়া হয়। এরপরে সেখানেই তাদের একটি জ্বালানী সরবরাহকারী স্টেশনের উপরে ধাতব গার্ডার থেকে উল্টে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনতা লাশগুলিকে মারধর করা করে, হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে, এমনকি মৃত দেহে গুলিও করা হয়েছিল।
প্রথমদিকে মুসোলিনীকে একটি চিহ্ন বিহীন সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কিন্তু মুসলিনি মনেহয় মৃত্যুর সাথে সাথে অশান্তি কে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, আর সে কারনেই ১৯৪৬ সালে সমাধি থেকে তাঁর দেহটি ফ্যাসিবাদী সমর্থকরা চুরি করে নিয়ে যায়। এর চার মাস পরে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেহাবশেষটি পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল এবং পরবর্তী এগারো বছর এটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো।
অবশেষে, ১৯৫৭ সালে, তাকে তাঁর নিজের শহর প্রেদাপিওতে সমাধিস্থ করা হয়। বর্তমানে তাঁর সমাধিটি নব্য-ফ্যাসিস্টদের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে এবং তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে নব্য-ফ্যাসিবাদীরা নিয়মিত বিভিন্ন সমাবেশ এর মাধ্যমে তাকে স্মরণ করে থাকে।
মুসোলিনির মৃত্যু ঘিরে উত্থাপিত কিছু বিতর্ক
যুদ্ধোত্তর বছরগুলিতে, ইতালিতে মুসোলিনির মৃত্যু (Death of Benito Mussolini) নিয়ে অফিসিয়াল কিছু বিবরণীতে (তবে, সাধারণত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়) এমনভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে যা জন এফ কেনেডি হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে তুলনার সামিল। সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং ঐতিহাসিকরা, অডিসিওর (মুসলিনির হত্যাকারী হিসেবে বেশিরভাগ স্বীকৃত ব্যাক্তি) অ্যাকাউন্টের সত্যতা নিয়ে বেশ সন্দেহ প্রকাশ করে।
মুসোলিনি কীভাবে মারা গিয়েছিলেন এবং কে দায়ী ছিলেন তা নিয়ে বিভিন্ন ধরণের তত্ত্ব ও জল্পনা ছড়িয়ে পরে। কমপক্ষে বারো জন পৃথক ব্যক্তি, বিভিন্ন সময়ে, মুসলিনির হত্যাকারী বলে নিজেদের দাবি করেছেন। এর মধ্যে লুইজি লঙ্গো এবং স্যান্ড্রো পার্টিনির মতো ব্যাক্তিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এরা এমন ব্যাক্তি যারা পরবর্তীতে যথাক্রমে ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং ইতালির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
বেশ কয়েক জন লেখক মনে করেন যে, মুসোলিনির মৃত্যু একটি ব্রিটিশ বিশেষ বাহিনীর অভিযানের অংশ ছিল। তবে মুসোলিনির হত্যাকারী হিসাবে অডিসিওর “অফিসিয়াল” ব্যাখ্যাটি সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে রয়ে গেছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে।
তথ্য সুত্র- https://en.wikipedia.org/wiki/Death_of_Benito_Mussolini
“Benito Mussolini: a Biography.” by Hibbert, Christopher.