সাইবেরিয়া অঞ্চলটি উত্তর এশিয়ার কাছাকাছি প্রায় সমস্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত। এটি রাশিয়ার মধ্য ও পূর্ব অংশে অবস্থিত এবং অঞ্চলটি ইউরাল পর্বতমালা থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত অংশকে ঘিরে রয়েছে। সাইবেরিয়া আর্কটিক মহাসাগর থেকে উত্তর কাজাখস্তান এবং মঙ্গোলিয়া ও চীন সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
সাইবেরিয়ার মোট আয়তন ৫১ লক্ষ বর্গমাইল (১ কোটি ৩১ লক্ষ বর্গ কিমি) এবং পুরো রাশিয়ার মোট আয়তনের ৭৭% অঞ্চল জুড়ে সাইবেরিয়ার অবস্থান।
সাইবেরিয়ার ইতিহাস
সাইবেরিয়ার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যা প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে প্রবাহমান। প্রথম দিকের প্রায় ৪০,০০০ বছর পূর্বে্র কিছু মানব প্রজাতির বিচরণের প্রমাণ দক্ষিণ সাইবেরিয়ায় পাওয়া গেছে।
এই প্রজাতিগুলির মধ্যে রয়েছে হোমো নিয়ান্ডারথ্যালেনসিস, যারা মানুষের আগের প্রজাতি হিসেবে পরিচিত এবং এরা হোমো সেপিয়েন্স মানুষ। এর পাশাপাশি সম্প্রতি ২০১০ সালের মার্চে একটি অজ্ঞাত প্রজাতির জীবাশ্মর সন্ধান এ অঞ্চলে পাওয়া গেছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বর্তমান সাইবেরিয়া অঞ্চলটি মঙ্গোলরা জয় করেছিল। সেই সময়ের আগে সাইবেরিয়ায় বিভিন্ন যাযাবর গোষ্ঠীর বসবাস ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে, ১৫০২ সালে গোল্ডেন হর্ড (মঙ্গোলীয় শাসন বাবস্থা) ভেঙে যাওয়ার পরে স্বতন্ত্র সাইবেরিয়ান খানেট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ষোড়শ শতাব্দীতে, রাশিয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং রাশিয়া সাইবেরিয়ান খানেটের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করা শুরু করে। শতাব্দীর প্রথমদিকে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী সাইবেরিয়ার পূর্ব অংশে দুর্গ স্থাপন শুরু করে। অবশেষে তারা, ইয়েনিসিস্ক এবং টোবলস্ক শহরগুলিতে অনুপ্রবেশ করে এবং এখানকার অঞ্চলগুলো দখল করা শুরু করে।
এই শহরগুলির বাইরে, সাইবেরিয়ার বেশিরভাগ অংশেই জনসংখ্যার বসবাস ছিল অনেক কম । কেবলমাত্র কতিপয় ব্যবসায়ী এবং কিছু অনুসন্ধানকারী এই অঞ্চলে বসবাস করতো। উনিশ শতকে রাশিয়া, ইম্পেরিয়াল রাশিয়া এবং এর বিভিন্ন অঞ্চলগুলো থেকে সাইবেরিয়ায় বন্দীদের প্রেরণ করা শুরু করে। এসময় প্রায় ১২ লক্ষ বন্দিকে সাইবেরিয়ার বিভিন্ন কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল।
ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ
ইতিহাসে বিখ্যাত এবং ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৯১ সালে, এই রেলপথ সাইবেরিয়াকে বাকী রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত করতে সাহায্য করে।
১৮০১ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ রাশিয়া্র ইউরোপীয় অংশ থেকে সাইবেরিয়ায় চলে এসেছিল এবং ১৮৫৯ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত (রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পরে) আরও ৫০০,০০০ লোক সাইবেরিয়ায় চলে আসে।
১৮৯৩ সালে, নভোসিবিরস্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা আজ সাইবেরিয়ার বৃহত্তম শহর। বিংশ শতাব্দীতে, রাশিয়া সাইবেরিয়ার বহু প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করা শুরু করে, সেই সাথে এসব অঞ্চলজুড়ে শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ কাজও আরম্ভ করে।
সাইবেরিয়ার জনসংখ্যা
প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হওয়ায়, ১৯০০ -এর দশকের গোড়ার দিকে, সাইবেরিয়ার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এ ছাড়াও, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে সাইবেরিয়ায় বেশকিছু কুখ্যাত কারাগার এবং শ্রম শিবির স্থাপন করা হয়েছিল যা পরবর্তী রাশিয়ান সাম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করে। ১৯২৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এই কারাগার এবং শ্রম শিবিরগুলোতে ১ কোটি ৪০ লক্ষেরও বেশি লোক কাজ করা শুরু করেছিল।
বর্তমানে সাইবেরিয়ার জনসংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লক্ষের বেশি এবং অঞ্চলটি বেশ কয়েকটি জেলায় বিভক্ত। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় শহর রয়েছে, যার মধ্যে নোভোসিবিরস্ক অন্যতম এবং এর জনসংখ্যা ১৩ লক্ষ যা জনসংখ্যার দিক দিয়ে এ অঞ্চলের শহরগুলির মধ্যে বৃহত্তম।
সাইবেরিয়ার জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ
সাইবেরিয়ার মোট আয়তন ৫১ লক্ষ বর্গমাইল। এর একটি বৈচিত্রময় ভৌগলিক অবস্থান রয়েছে যা এর বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। সাইবেরিয়ার প্রধান ভৌগলিক অঞ্চলগুলি হ’ল পশ্চিম সাইবেরিয়ান মালভূমি এবং সেন্ট্রাল সাইবেরিয়ান মালভূমি।
পশ্চিম সাইবেরিয়ান মালভূমি মূলত সমতল এবং জলাবদ্ধ অঞ্চল। সেন্ট্রাল সাইবেরিয়ান মালভূমি একটি প্রাচীন আগ্নেয়গিরি সমৃদ্ধ অঞ্চল যা ম্যাঙ্গানিজ, সীসা, দস্তা, নিকেল এবং কোবাল্টের মতো প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদে ভরপুর। এখানে হীরা এবং সোনার অস্তিত্ব রয়েছে এমন বেশ কিছু অঞ্চলও রয়েছে।
তবে এই অঞ্চলটির বেশিরভাগ অংশ পারমাফ্রস্ট এর (একপ্রকার পাথুরে ভুমি যেখানে বছরের পর বছর তাপমাত্রা ০(শুন্য) ডিগ্রির আশেপাশে থাকে) অধীনে রয়েছে।
এ সকল প্রধান অঞ্চলগুলির বাইরে, সাইবেরিয়ায় বেশ কয়েকটি শক্তিশালী পর্বতশ্রেণী রয়েছে যার মধ্যে ইউরাল পর্বতমালা, আলতাই পর্বতমালা এবং ভারখোয়ানস্ক রেঞ্জ রয়েছে। সাইবেরিয়ার সর্বোচ্চ পয়েন্ট হ’ল ক্লাইচেভস্কায়া সোপকা। এটি কামচাতকা উপদ্বীপে অবস্থিত একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, এবং এর উচ্চতা ১৫,২৫৩ ফুট (৪,৬৪৯ মি)।
সাইবেরিয়াতে বৈকাল হ্রদ অবস্থিত – এটি বিশ্বের প্রাচীনতম এবং গভীরতম হ্রদ। বৈকাল লেকটি প্রায় ৩ কোটি বছর পুরানো বলে মনে করা হয় এবং এর গভীরতম স্থানের গভীরতা ৫,৩৮৭ ফুট (১,৬৪২ মিটার)। এটিতে পৃথিবীর মোট স্বাদু পানীয় জলের প্রায় ২০% অংশ।
সাইবেরিয়ার প্রায় সব গাছপালা তাইগা, তবে এর উত্তরে টুন্ড্রা অঞ্চল এবং দক্ষিণে সমীচীন বনাঞ্চল রয়েছে। সাইবেরিয়ার বেশিরভাগ জলবায়ু প্রচন্ড শীতল এবং কামচাতকা উপদ্বীপ ব্যতীত অন্যান্য স্থানে বৃষ্টিপাত খুব কম হয়।
সাইবেরিয়ার বৃহত্তম শহর নোভোসিবিরস্কের গড় নিম্ন তাপমাত্রা -৪ ডিগ্রি ফরেনহাইট (-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), এবং জুলাইয়ের দিকে গড় উচ্চতর তারমাত্রা ৭৮ ডিগ্রি ফরেনহাইট (২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত পৌঁছায়।
অর্থনীতি এবং সাইবেরিয়ার মানুষ
সাইবেরিয়া খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ যা এর প্রাথমিক উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করেছে এবং এখানকার অর্থনীতির বেশিরভাগ অংশ এ অঞ্চলের উপর নির্ভরশীল। তবে এখানকার কৃষিকাজ অনেক সীমিত কারণ পারমাফ্রস্ট অঞ্চল এবং বরফাবৃত মৌসুম এর প্রধান অন্তরায়।
সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সরবরাহের কারনে, এই অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, এখানকার বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ৩.৬ কোটি, যার বেশিরভাগ রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত। তবে জাতিগত জার্মান এবং অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির মানুষও কিছু রয়েছে। সাইবেরিয়ার সুদূর পূর্বাঞ্চলেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে চীনা । যারা সাইবেরিয়ার প্রায় সমস্ত জনসংখ্যার ৭০% শহরে বাস করে।
সুতরাং, বলতে পারি, উপরে আমরা যে তথ্যগুলো পেয়েছি তাতে সাইবেরিয়া যে, রাশিয়ার বৃহত্তম বরফাবৃত রহস্য ঘেরা অঞ্চল, এটা বলা মনে হয় খুব একটা বেঠিক কিছু নয়।