মার্ক জুকারবার্গ (Mark Zuckerberg)
মার্ক জুকারবার্গ (Mark Zuckerberg) হার্ভার্ড বিশ্ব বিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের একজন প্রাক্তণ শিক্ষার্থী, যিনি কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ফেসবুক চালু করেছিলেন। জুকারবার্গ মাত্র ২৪ বছর বয়সে ২০০৮ সালে বিশ্বের কনিষ্ঠতম বিলিয়নিয়ার হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে “ম্যান অফ দ্য ইয়ার” হিসেবে ঘোষণা করেছিল। জুকারবার্গ বর্তমানে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সভাপতি। প্রিয়, পাঠক আজ আমরা মার্ক জুকারবার্গ সম্পর্কে জানতে চলেছি। জুকারবার্গ হয়তো আমাদের মতোই একজন মানুষ, কিন্তু তিনি খুব একটা সাধারন মানুষ নয়। তাই চলুন জেনে আসি এ অসাধারন মানুষটি সম্পর্কে।
মার্ক জুকারবার্গের (Mark Zuckerberg) জন্ম ১৪ ই মে, ১৯৮৪ সালে, নিউইয়র্কের হোয়াইট প্লেইনে। চিকিৎসাবিদ এডওয়ার্ড জুকারবার্গ এবং তাঁর স্ত্রী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ক্যারেন জুকারবার্গের চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান তিনি। তিনি বর্তমানে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রেসিডেন্ট এবং ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ার হিসেবে সারা বিশ্বে সমানভাবে পরিচিত একজন ব্যাক্তি।
জুকারবার্গ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ফিলিপস এক্সেটার একাডেমি থেকে, এবং হার্ভার্ড বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্সে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার স্ত্রীর নাম প্রিসিলা চ্যান এবং তাদের বিয়ে হয় ২০১২ সালের মে মাসে। ম্যাক্সিমা চ্যান জুকারবার্গ এবং আগস্ট চ্যান জুকারবার্গ নামে দুটি সন্তান রয়েছে তাদের।
কম্পিউটার সাইন্সের প্রতি জুকারবার্গ এর আগ্রহ
শৈশব থেকেই জুকারবার্গ তার বাবার সক্রিয় সহযোগিতায় মিডল স্কুলের কম্পিউটার ব্যবহার এবং প্রোগ্রামিং শুরু করেছিলেন। এডওয়ার্ড জুকারবার্গ ১১ বছর বয়সী ছেলেকে কম্পিউটারের বেসিক সম্পর্কে ভাল জ্ঞান আহরন করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন এবং এরপর তিনি তার ছেলেকে ব্যক্তিগত পাঠ দেওয়ার জন্য ডেভিড নিউম্যানকে নিয়োগ করেছিলেন, যিনি ছিলেন সফটওয়ার সম্পর্কে বিশেষভাবে পারদর্শী একজন জ্ঞানী ব্যাক্তি।
১৯৯৭ সালে যখন মার্ক জুকারবার্গ এর বয়স মাত্র ১৩ বছর, তখন তিনি তার পরিবারের জন্য একটি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন এবং এর নাম দিয়েছিলেন জুকনেট। ১৯৯৮ সালে AOL এর ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেঞ্জারের একটি প্রাথমিক সংস্করণ যা পিংয়ের মাধ্যমে তার বাড়ির কম্পিউটার এবং তার বাবার ডেন্টাল অফিসের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। তিনি কম্পিউটার গেমসও তৈরি করেছিলেন।
এর দু’বছর পরে, জুকারবার্গ পাবলিক হাই স্কুল আর্ডসলে পড়াশোনা শুরু করেন এবং তারপরে ফিলিপস এক্সেটার একাডেমিতে স্থানান্তরিত হন, যেখানে তিনি শাস্ত্রীয় জ্ঞান এবং বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞানের জন্য পুরষ্কারও জিতেছিলেন। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়, জুকারবার্গ ফ্রেঞ্চ, হিব্রু, লাতিন এবং প্রাচীন গ্রীক পড়তে এবং লিখতে পারতেন।
এক্সেটারে পড়া কালীন সময়ে তিনি তার সিনিয়র প্রকল্পের জন্য, সিনাপস মিডিয়া প্লেয়ার নামে একটি সংগীত প্লেয়ার ডেভ্লপ করেছিলেন যা ব্যবহারকারীর শোনার অভ্যাস গড়তে এবং অন্যান্য সংগীত সম্পর্কে জানানোর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করেছিলেন।
তিনি এটি এওএল-এ্রর অনলাইন পোর্টালে পোস্ট করতেন এবং সেখানে এগুলো হাজার হাজার ইতিবাচক রিভিউ পেয়েছিল। মাইক্রোসফ্ট এবং এওএল উভয়ই সিনাপসকে এক মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল এবং মার্ক জুকারবার্গেকে একজন ডেভ্লপার হিসাবে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল।
তবে সে দু’জনকেই ফিরিয়ে দেয় এবং এর পরিবর্তে তিনি আরও জ্ঞান চর্চার জন্য ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলেন।
হার্ভার্ডে মার্ক জুকারবার্গ

মার্ক জুকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, সেখানে তিনি মনোবিজ্ঞান এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি যে বছরে সফটওয়্যার তৈরি করেন, সে সময় তিনি একটি প্রোগ্রাম লিখেছিলেন যা কোর্স ম্যাচ নামে পরিচিত। এ প্রোগ্রাম ব্যবহারকারীদের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের পছন্দের উপর ভিত্তি করে শ্রেণি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে এবং তাদের অধ্যয়নের বিশয় গঠনে সহায়তা করার জন্য বেশ সহায়ক হয়েছিলো।
ক্যাম্পাসের সর্বাধিক আকর্ষণীয় ব্যক্তি কে? তা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ফেসমাস নামে একটি প্রোগ্রাম আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। এ প্রোগ্রাম ব্যবহারকারীরা একই লিঙ্গের লোকদের দুটি ছবি দেখতে পেতেন এবং নির্বাচন করতেন যে কোন ছবিটি “সবচেয়ে হট” এবং সফ্টওয়্যারটি এ ধরনের ফলাফলগুলো সম্পাদনা করে র্যাঙ্ক করানোর জন্য উপযোগী ছিল।
মার্ক জুকারবার্গ (Mark Zuckerberg) এবং সারা পৃথিবীর জন্য সে সময় এটি একটি বিস্ময়কর সাফল্য ছিল। তবে এটি হার্ভার্ডে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো না, কারন এখানে যে ছবিগুলো ব্যবহার করা হতো তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা হয়েছিল, এবং এটি ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা, বিশেষত মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ আপত্তিজনক ছিল।
এ অবস্থায় জুকারবার্গ প্রকল্পটির ইতি টানেন। তিনি মেয়েদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, তিনি এটিকে কম্পিউটারের একটি পরীক্ষা হিসাবে নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও হার্ভার্ড প্রশাসন তাকে প্রবেশনে রেখেছিল।
ফেসবুক আবিষ্কার এবং এর প্রসার
হার্ভার্ডে জুকারবার্গের রুমমেটদের মধ্যে ক্রিস হিউজ ছিলেন, একজন সাহিত্য ও ইতিহাসের ছাত্র, বিলি ওলসন ছিলেন, একটি থিয়েটারের প্রধান এবং ডাস্টিন মোসকোভিটস, যিনি অর্থনীতি পড়ছিলেন।
এতে কোনও সন্দেহ নেই যে তাদের মধ্যে সে সময় যে কথোপকথন হতো তা অনেকটাই জুকারবার্গ যে কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করেছিলেন এবং যে প্রকল্পগুলি নিয়ে কাজ করছিলেন, সেগুলি তার রুমমেট দের অনেক উত্সাহিত করেছিল এবং কোন একটি পদক্ষেপ গ্রহনের ক্ষেত্রে অনেক সহযোগীতা করেছিল।
হার্ভার্ডে থাকাকালীন মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক নামক অ্যাপ্লিকেশনটি তৈরি করেছিলেন, এটি এমন একটি অ্যাপ্লিকেশন ছিল যা হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সত্যিকারের তথ্যের ভিত্তিতে নির্ভরযোগ্য একটি ডিরেক্টরি তৈরিতে সাহায্য করেছিলো। সেই সফ্টওয়্যারটি শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারী ২০০৪-এ ফেসবুক চালু করার দিকে পরিচালিত করে।
জুকারবার্গ তার সহকর্মীদের নিয়ে হার্ভার্ডে ফিরে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে তারা অনেক বড় বড় কর্পোরেশনের ফেসবুক কেনার অফার প্রত্যাখ্যান করেছিল।
২০০৭ সালে একটি সাক্ষাত্কারে জাকারবার্গ যুক্তি দিয়ে বিশয়টি ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন “এটি অর্থের পরিমাণের কারণে নয়। আমার এবং আমার সহকর্মীদের জন্য, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল আমরা মানুষের জন্য একটি উন্মুক্ত তথ্য প্রবাহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। সংঘবদ্ধদের মালিকানাধীন মিডিয়া কর্পোরেশনগুলি কেবলমাত্র আমার কাছে আকর্ষণীয় ধারণা মাত্র।
২০১০ সালের ২১ জুলাই তারিখে, ফেসবুক ৫০০ মিলিয়ন-ব্যবহারকারীর দোর গোরায় পৌঁছে যায়। ফেসবুক তার অভূতপূর্ব বিকাশের ফলস্বরূপ বিজ্ঞাপন থেকে আরও বেশি আয় করতে পারে কিনা সে সম্পর্কে জানতে প্রাক্তন নেটস্কেপ সিএফও পিটার কুরির পরামর্শ চেয়েছিল।
এরপর, স্টিভ জবসের মৃত্যুর পরপরই ২০১১ সালে পিবিএসের সাথে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে জুকারবার্গ বলেছিলেন যে, জবস তাকে ফেসবুককে পরিচালনার জন্য কিভাবে একটি ভাল দল তৈরি করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত টেকক্রাঞ্চ সম্মেলনে জুকারবার্গ বলেছিলেন, ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত নয় এমন ৫ বিলিয়ন মানুষকে ফেসবুকে অন্তর্ভুক্তি করনের লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি। জাকারবার্গ তখন আরও ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ইন্টারনেট.আরজেজেটের প্রকল্পের সাথে ফেসবুক জড়িত রয়েছে, এর মাধ্যমে ফেসবুক অন্যান্য প্রযুক্তি সংস্থার সহায়তায়, ইন্টারনেটে সংযুক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
২০১৪ সালের মার্চে স্পেনের বার্সেলোনায় অনুষ্ঠিত ২০১৪ মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে (এমডাব্লুসি) প্রধান বক্তা ছিলেন জুকারবার্গ, যেখানে ৭৫,০০০ প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মোবাইল প্রযুক্তিতে ফেসবুকের অন্তর্ভুক্তি তৈরি করা এবং জুকারবার্গের বক্তৃতার মধ্যকার সংযোগ তুলে ধরে দাবি করা হয়েছিলো যে মোবাইল কোম্পানিগুলো ভবিষ্যতে প্রতিনিধিত্ব করবে।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে টেকক্রাঞ্চ সম্মেলনে জুকারবার্গ যে বক্তব্য উত্থাপন করেছিলেন, তার সঙ্গে এটার অনেক মিল ছিল। তিনি আরও বলেছিলেন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ইন্টারনেটের প্রচার বাড়ানোর দিকেও কাজ করছেন তিনি।
জেফ বেজোস এবং টিম কুকের মতো আমেরিকান প্রযুক্তির অনন্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি, জুকারবার্গও আমেরিকা সহ সারা পৃথিবীর নিকট অন্যতম সেরা একজন মেধাবী প্রযুক্তিবিদ।
জুকারবার্গ ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে এক ডলারের বেতন পান। ২০১৬ সালের জুন মাসে, বিজনেস ইনসাইডার এলোন মাস্ক এবং সাল খানের সাথে জাকারবার্গকে “শীর্ষস্থানীয় ১০ টি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য সারা বিশ্বে মূল্যবান ব্যাক্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছে। যে কারণে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী “তাদের ৯৯% সম্পদ দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা অনুমান করা হয় প্রায় ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো।