(Benito Mussolini)

বেনিটো মুসোলিনি- অ্যাডলফ হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব

বেনিটো মুসোলিনি (Benito Mussolini), যাকে ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ জন্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিবেচিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে যিনি অক্ষশক্তির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বেনিটো মুসোলিনি  ইতালির ৪০ তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

১৯৪৩ সালে, মুসোলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পুনঃ নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৫ সালে তার বিপক্ষ গোষ্ঠী দ্বারা গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া পর্যন্ত তিনি ইতালীর সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।  

বেনিটো মুসোলিনির শৈশব

বেনিটো মুসোলিনি (Benito Mussolini)
বেনিটো মুসোলিনি(Benito Mussolini) এবং তার কিছু অনুসারী

বেনিটো এমিলকেয়ার আন্দ্রেয়া মুসোলিনি (Benito Mussolini) উত্তর ইতালির ভেরানো ডি কোস্টার প্রেডাপিওতে ১৮৮৩ সালের ২৯, জুলাই  জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মুসোলিনির পিতা আলেসান্দ্রো ছিলেন একজন কামার এবং ধর্মকে অবমাননাকারী প্রভাবশালী একজন সমাজপতি। তাঁর মা রোজা মালটনি ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক।

মুসোলিনির দুইজন ছোট ভাইবোন ছিল, ভাইয়ের নাম আর্নাল্ডো এবং বোন এডভিজ। বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে মুসোলিনি, প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি কতটা বেয়ারা প্রকৃতির। তিনি ছিলেন চরম অবাধ্য এবং দ্রুতই মেজাজ হারাতেন। সহ-শিক্ষার্থীদের পেন-নাইফ দিয়ে অত্যাচার করার জন্য দুইবার তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ সকল সমস্যার পরেও তিনি ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং এমনকি স্কুল শিক্ষক হিসাবে অল্প সময়ের জন্যও কাজ করেছিলেন। 

সমাজতান্ত্রের প্রতি মুসোলিনির আগ্রহ 

স্কুল শিক্ষকের থেকে চাকরির চেয়ে আরও ভাল সুযোগের সন্ধানে, মুসোলিনি ১৯০২ সালের জুলাই মাসে সুইজারল্যান্ডে চলে যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন রকমের চাকরি করা শুরু করেন এবং সন্ধ্যায় স্থানীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভায় যোগ দিতে শুরু করেন।

ব্রিক্লেয়ার ট্রেড ইউনিয়নের প্রচারক হিসাবেও তিনি কাজ করেছিলেন। সে সময়, মুসোলিনি একটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি প্রায়শই সহিংসতার পক্ষে ছিলেন এবং কিছু একটা পরিবর্তন আনার জন্য তিনি একটি সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানান, যার ফলে তাকে সে সময় বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। 

দিনের বেলা ট্রেড ইউনিয়নে তাঁর কিছু অসংলগ্ন কাজ এবং রাতে সমাজতান্ত্রিকদের সাথে তাঁর  বহু বক্তৃতা এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে মুসোলিনী দ্রুততার সাথে চেনাশোনা সমাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজের পক্ষে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। এখানে নাম লেখানোর পাশাপাশি  তিনি বেশ কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক সংবাদপত্র রচনা ও সম্পাদনাও শুরু করেছিলেন।

১৯০৪ সালে, বেনিটো মুসোলিনি (Benito Mussolini) ইতালির সেনাবাহিনীতে তার নিবন্ধণের জন্য দেশে ফিরে আসেন। ১৯০৯ সালে তিনি অস্ট্রিয়াতে অল্প সময়ের জন্য একটি ট্রেড ইউনিয়নের হয়ে কাজ করেছিলেন। এখানে, মুসোলিনি একটি সমাজতান্ত্রিক পত্রিকার জন্য লিখতেন এবং সামরিকতা ও জাতীয়তাবাদে তার আক্রমনাত্মক লেখার ফলে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল।

ইতালি ফিরে আসার পরে, মুসোলিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বক্তা হিসাবে তাঁর দক্ষতার বিকাশ ঘটানো অব্যাহত রাখেন। তিনি বলপ্রয়োগকারী এবং প্রচন্ড কর্তৃত্ব পরায়ন মানুষ ছিলেন। তাঁর মতামত এবং বক্তৃ্তার দক্ষতা তাকে দ্রুত তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে শীর্ষে নিয়ে আসে। ১৯১২ সালের ১ ডিসেম্বর মুসোলিনি ইতালীয় সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা ” অবন্তীর ” সম্পাদক হিসাবে কাজ শুরু করেন!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মুসোলিনির ভুমিকা

বেনিটো মুসোলিনি(Benito Mussolini) এবং হিটলার
বেনিটো মুসোলিনি(Benito Mussolini) এবং হিটলার

১৯১৪ সালে আর্চডুক ফ্রাঞ্জ ফারদিনান্ডের হত্যাকাণ্ড প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটায়।  ১৯১৪ সালের, আগস্টে ইতালির সরকার ঘোষণা করে যে তারা যুদ্ধ থেকে নিরপেক্ষ থাকবে। এ সময় মুসোলিনী অবন্তী পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে তাঁর অবস্থান প্রকাশ করেছিলেন, সহযোগী সমাজতন্ত্রীদের নিরপেক্ষতার অবস্থানে সরকারকে সমর্থন করার আহ্বান জানানো্র মাধ্যমে।

তবে শীঘ্রই যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মুসোলিনী তার পত্রিকায় একাধিক নিবন্ধ লিখেছিলেন, যারা যুদ্ধে ইতালির যোগদানকে সমর্থন করেছিলেন তাদের সমর্থন করে। মুসোলিনির সম্পাদকীয়গুলি তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে একটি হট্টগোল সৃষ্টি করেছিল এবং সে বছরের নভেম্বর মাসে দলীয় কার্যনির্বাহী সভার পরে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ১৯১৫ সালের ২৩ মে ইতালি মিত্র শক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে মুসোলিনি তাতে যোগ দেন।

১৯১৭ সালে জুদ্ধরত অবস্থায় একটি মর্টার শেল বিস্ফোরণে তিনি মারাত্মক আহত হন। একটি সামরিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন অবস্থানের পরে, তিনি আহত অবস্থা থেকে সেরে ওঠেন এবং সেনাবাহিনী থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

ফ্যাসিবাদে মুসোলিনি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, মুসোলিনি অনেকটা সমাজতন্ত্রবিরোধী হয়ে পরেছিলেন। ইতালিতে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে পরামর্শদাতা হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। এবং শীঘ্রই তিনি সেই সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এক স্বৈরশাসকের পক্ষেও বিভিন্ন পরামর্শ দিতে থাকেন।

মুসোলিনি একা একা বড় কোন পরিবর্তনের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তবে তিনি দেশটিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য একটি উপায় খুঁজছিলেন। এ সময় জাতীয়তাবাদের ঢেউ পুরো ইতালি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু লোক স্থানীয় জাতীয়তাবাদী সংগঠন তৈরি করতে শুরু করে।

মুসোলিনি, ১৯১৯ সালের ২৩ শে মার্চ ব্যক্তিগতভাবে এইসব দলগুলিকে তাঁর একক নেতৃত্বে, জাতীয় সংগঠন হিসেবে একত্রিত করেছিলেন। মুসোলিনির এই নতুন গ্রুপটিকে ফ্যাসি ডি কমব্যাটিমেন্টো (ফ্যাসিস্ট পার্টি) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

মুসোলিনি প্রাক্তন সেনা সদস্যদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছিলেন। তাদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে স্কোয়াডরিস্টিটি লা সিসুরিসা নাজিওনালে বা এমভিএসএন মিলিজিয়া ভোল্টনারিয়ায় পুনর্গঠিত হয়েছিল। এরা পরবর্তীকালে মুসোলিনির জাতীয় সুরক্ষা ব্যাবস্থা হিসাবে কাজ করে। এবং কালো শার্ট বা সোয়েটার পরিহিত স্কোয়াড “ব্ল্যাকশার্ট” ডাকনাম অর্জন করেছিল।  

১৯২২ সালের গ্রীষ্মে, ব্ল্যাকশার্ট সংগঠনটি উত্তর ইতালির রাভেনা, ফোরলি এবং ফেরারা প্রদেশে একটি শাস্তিমূলক পদযাত্রা করেছিল। কিন্তু এটি ছিল সন্ত্রাসের সুচনা, স্কোয়াডটি সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট উভয় সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যের সদর দফতর এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।

১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে, ব্ল্যাকশার্ট বাহিনী উত্তর ইতালির বেশিরভাগ অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মুসোলিনি ইতালির রাজধানী রোমে একটি অভ্যুত্থান এর বিষয়ে আলোচনা করার জন্য ২৪ অক্টোবর, ১৯২২ এ একটি ফ্যাসিস্ট পার্টির সম্মেলন জোট গঠন করেছিলেন। ২৮ শে অক্টোবর, ব্ল্যাকশার্টের সশস্ত্র বাহিনী রোমের দিকে যাত্রা শুরু করে। যদিও অপরিকল্পিতভাবে সংগঠিত এবং দুর্বল সশস্ত্র, এই পদক্ষেপ রাজা তৃতীয় ভিক্টরের সংসদীয় রাজতন্ত্রকে বেশ বিভ্রান্তিতে ফেলেছিল।

এ সময় মুসোলিনি রাজার কাছ থেকে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব পেয়েছিলেন। এরপরে তিনি ৩,০০,০০০ লোক দ্বারা সমর্থিত কালো শার্ট পরা বাহিনী নিয়ে রাজধানীতে চলে যান। ১৯২২ সালের ৩১ শে অক্টোবর, ৩৯ বছর বয়সে মুসোলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। 

নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে, মুসোলিনি নিজেকে ইতালির ইল ডুস (“প্রধান নেতা”) নিয়োগের জন্য সংসদে পর্যাপ্ত আসন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালের ৩ জানুয়ারি তাঁর ফ্যাসিস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার সহায়তায় মুসোলিনি নিজেকে ইতালির স্বৈরশাসক হিসাবে ঘোষণা করেন। 

এক দশক ধরে ইতালি শান্তিপূর্ণ এবং বেশ সমৃদ্ধ শালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো। তবে মুসোলিনি ইতালিকে একটি বিশাল সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করতে তার ফ্যাসিস্ট নীতি খুব ভালো ভাবেই প্রয়োগ করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে ১৯৩৫ সালের অক্টোবরে ইতালি ইথিওপিয়ায় আক্রমণ করে। বেনিটো মুসলিনির (Benito Mussolini) এ বিজয়টি ছিল অত্যান্ত নির্মম। কারন, আক্রমণে তিনি মাস্টারড গ্যাস ব্যাবহার করেন। এ সময় অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলি ইতালির সমালোচনা করে, কিন্তু মুসলিনি এটার পাত্তাই দেননি। ১৯৩৬ সালের মে মাসে ইথিওপিয়া আত্মসমর্পণ করে এবং এ অঞ্চলে মুসোলিনির সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয়। 

মুসোলিনির সঙ্গে হিটলারের সখ্যতা

বেনিটো মুসোলিনি(Benito Mussolini) সাথে হিটলারের সাক্ষাত
বেনিটো মুসোলিনি(Benito Mussolini) সাথে হিটলারের সাক্ষাত

ইউরোপের সমস্ত দেশগুলির মধ্যে জার্মানিই ছিল ইথিওপিয়ায় মুসোলিনির আক্রমণকে সমর্থন করার একমাত্র দেশ। সেই সময়, জার্মানির নেতৃত্বে ছিল অ্যাডল্ফ হিটলার, যিনি তাঁর নিজস্ব ফ্যাসিবাদী সংস্থা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (সাধারণত নাৎসি পার্টি নামে পরিচিত) গঠন করেছিলেন।

হিটলার মুসোলিনির প্রশংসা করেছিলেন ঠিকই, তথাপি মুসোলিনি  কিন্তু প্রথমে হিটলার কে পছন্দ করেননি। এটা জানা সত্ত্বেও হিটলার মুসোলিনিকে সমর্থন করা অব্যাহত রেখেছিলেন, এবং অধ্যাবসায়ের ফল হিসেবে, ইথিওপিয়া যুদ্ধের শেষেরদিকে মুসোলিনিকে তার সাথে জোটবদ্ধ করে তোলে।

১৯৩৮ সালে, মুসোলিনি একটি ইশতেহার পাস করেছিলেন, যা ইতালির ইহুদীদের তাদের ইতালীয় নাগরিকত্ব থেকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে নিয়েছিল, মূলত এটি ছিল হিটলারের একটি কুটনৈতিক চাল। এ ইশতেহার, ইহুদিদের সরকারী এবং শিক্ষাদানের চাকুরী থেকে সরিয়ে দিয়েছিল এবং বিবাহ বন্ধনে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিল। প্রকৃত অর্থে ইতালি সে সময় জার্মানির নাৎসি নীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করছিল। 

২২ শে মে, ১৯৩৯, মুসোলিনি হিটলারের সাথে “প্যাক্ট অফ ষ্টীল” চুক্তিতে নিজেকে জরিয়ে ফেলে, যা কোন একটি যুদ্ধ শুরু করার ক্ষেত্রে দুটি দেশকেই মূলত একত্রিত করে দেয়। এতে করে একটি পূর্বাভাসই পাওয়া গিয়েছিল যে খুব শীঘ্রই যুদ্ধ আসতে চলেছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি

১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ সালে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে। পোল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জার্মানির সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং হিটলারের বিজয় প্রত্যক্ষ করার পরে মুসোলিনি ১৯৪০ সালের ১০ জুন ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা জারি করেন। তবে প্রথম থেকে এটি পরিষ্কার ছিল যে, মুসোলিনি হিটলারের সাথে আক্রমণ বা বিজয়ের সমান অংশীদার ছিলেন না এবং মুসোলিনি তা পছন্দও করেননি।

মুসোলিনি এবং হিটলার পারস্পরিক মিত্র থাকা সত্ত্বেও, সময়ের সাথে সাথে, মুসোলিনি হিটলারের সাফল্যে বেশ ঈর্ষা পরায়ন হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে, হিটলার তাঁর বেশিরভাগ সামরিক পরিকল্পনা মুসোলিনির কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন বলে তিনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। মুসোলিনি হিটলারের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত না হলেও হিটলারের কৃতিত্বের অনুকরণ করার একটি উপায় খোঁজা শুরু করেছিলেন।

তার সেনাপতিদের পরামর্শে মুসোলিনি ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরে মিশরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর আদেশ দেন। প্রথমে প্রাথমিক সাফল্যে আসলেও পরবর্তীতে আক্রমণটি স্থবির হয়ে পরে এবং ইতালির এ দুরবস্থা দেখে এবং মিশরে ইতালির অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য হিটলার সেখানে জার্মান সেনা পাঠায়।

মিশরে তাঁর সেনাবাহিনীর ব্যর্থতায় মুসোলিনি লজ্জিত হয়ে পড়েন। এর পরও মুসোলিনি হিটলারের পরামর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে, ২৮ শে অক্টোবর, ১৯৪০ সালে গ্রীসে আক্রমণ করেছিলেন। এর ছয় সপ্তাহ পরে, এই আক্রমণও থেমে যায়। পরাজিত হয়ে মুসোলিনি জার্মান একনায়কের সহায়তা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল জার্মানি যুগোস্লাভিয়া এবং গ্রীস উভয় দেশে আক্রমণ করে এবং তাদেরকে নির্মমভাবে পরাজিত করে এবং এখানেও মুসোলিনিকে পরাজয় থেকে উদ্ধার করে হিটলার। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম বছরগুলিতে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর বিজয় এবং জার্মানির সাথে ইতালির সখ্যতা সত্ত্বেও, বেশ কয়েকটি বিষয়ে জার্মানি এবং ইতালি পারস্পরিক বিপক্ষ দলে  পরিণত হয়। ১৯৪৩ এর গ্রীষ্মে জার্মানি রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে বেশ বেকায়দায় পরে যায়, এ সময় মিত্রবাহিনী রোমে বোমা বর্ষণ শুরু করে এবং ইতালীর ফ্যাসিস্ট কাউন্সিলের সদস্যরা মুসোলিনির বিরুদ্ধে চলে যায়।

তারা একত্রিত হয়ে রাজাকে তার সাংবিধানিক ক্ষমতা পুনরায় প্রয়োগ করার জন্য বাধ্য করে। ফলশ্রুতিতে, মুসোলিনীকে গ্রেপ্তার করে আব্রুজ্জি-র ক্যাম্পো ইম্পেরাতোরের একটি পর্বত রিসর্টে প্রেরণ করা হয় এবং বন্দী করা হয়।

১৯৪৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মুসোলিনীকে কারাগার থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল জার্মান গ্লাইডার দল ওটো স্কোরজয়ের নেতৃত্বে। উদ্ধারের পর তাকে মিউনিখে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল এবং তার পরেই হিটলারের সাথে  মুসোলিনীর দেখা হয়। এর দশ দিন পরে, হিটলারের আদেশে মুসোলিনীকে উত্তর ইতালিতে ইতালীয় সামাজিক প্রজাতন্ত্রের প্রধান হিসাবে ক্ষমতাসীন করা হয়েছিল, এবং এটি অবশ্যই জার্মানির নিয়ন্ত্রণে ছিল। 

প্রিয় পাঠক, এটুকুতে আপনারা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছেন, মুসোলিনীর প্রকৃত যুদ্ধজ্ঞান আসলেই কতটা প্রখর ছিল। 

মুসোলিনীর মৃত্যু

পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা ইতালি ও জার্মানির অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল মুসোলিনি স্পেনে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ২৮ শে এপ্রিল বিকেলে সুইজারল্যান্ডে একটি বিমানে চড়াতে যাওয়ার সময় মুসোলিনি এবং তার উপপত্নী ক্লেরেট্টা পেটাকিকে ইতালীয় পার্টিশনরা ধরে নিয়ে যায়।

ভিলা বেলমন্টের গেটে , তাদের উপর বিপক্ষ দলের চালানো গুলিতে মুসোলিনী, তার স্ত্রী এবং অন্যান্য কিছু সঙ্গী মারা গিয়েছিল(মুসলিনির মৃত্যু বিষয়ে কিছু বিতর্ক আছে)। ১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল মুসোলিনি, পেটাকি এবং তাদের দলের অন্যান্য সদস্যদের লাশগুলো ট্রেনে করে পিয়াজা লোরেটোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সেখানে, মুসোলিনির লাশ রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল এবং স্থানীয় পাড়ার লোকেরা তার লাশটিকে গালি দিয়েছিল। কিছু সময় পরে, মুসোলিনি এবং পেটাকির মৃতদেহগুলি একটি জ্বালানী সরবরাহকারী স্টেশনের সামনে উল্টে ঝুলানো হয়েছিল। এবং এরপর তাদের প্রাথমিকভাবে মিলানের মুসোকো কবরস্থানে বেনামে দাফন করা হয়েছিল। (মুসোলিনীর মৃত্যু নিয়ে এ লেখাটি পড়তে পারেন এখানে ক্লিক করে)

এভাবেই, একটা কিংবদন্তীর সমাপ্তি ঘটে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিয়ান ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়েছিল তথাপি গণ ফ্রিডম পার্টি এবং ইতালীয় সামাজিক আন্দোলন সহ বেশ কয়েকটি নব্য-ফ্যাসিবাদী এবং সুদূরপ্রসারী কিছু সংগঠনকে তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে।

 

তথ্য সুত্র- “Benito Mussolini: a Biography.” by Hibbert, Christopher.

       https://en.wikipedia.org/wiki/Benito_Mussolini

      www.throughco.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top