ইতিহাসে বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ এবং অনেক রুপকথার জন্মদানকারী বাগদাদ নগরী ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর এর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সহ বিভিন্ন দিক দিয়ে বিখ্যাত এ নগরীকে ইসলামের ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ইতিহাসে সমৃদ্ধ এ নগরীর ধ্বংস ডেকে আনতে, ইলখানাতের মঙ্গোল এবং তাদের মিত্ররা মাত্র তের দিন সময় নিয়েছিল। তখনকার কিছু প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছিল যে, শক্তিশালী টাইগ্রিস নদীর পানি বাগদাদের গ্র্যান্ড লাইব্রেরি বা বায়ত আল-হিকমাহ সহ ধ্বংস করা বহু মূল্যবান বই ও নথিপত্রের কালিতে কালো রঙের হয়ে গিয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে, আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের কতজন নাগরিক মঙ্গোলদের হামলায় মারা গিয়েছিলেন তা কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না।
তবে অনুমান করা হয়, এ সংখ্যা ৯০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ পর্যন্ত ছিল। আবার কারও মতে সেখানে মৃতের সংখ্যা ১০,০০,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মাত্র দুই সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত জায়গাটি একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায়।
বাগদাদ নগরী
৭৬২ সালে মহান আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর দ্বারা রাজধানী নগরী হিসাবে মর্যাদার আসনে উন্নীত হওয়ার আগে বাগদাদ একটি ঘুমন্ত চুপচাপ জেলেদের গ্রাম ছিল। খলিফা আল-মনসুর এর নাতি হারুন-আল-রশিদ যিনি এই শহরকে মধ্যযুগীয় বিশ্বের একাডেমিক রত্ন হিসাবে পরিণত করেছিলেন।
বিদ্বান ও লেখকগণ অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ১২৫৫ সালের মধ্যে অসংখ্য পান্ডুলিপি এবং বই রচনা করেছিলেন (যে গুলো ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হতো)।
চীনাদের সাথে তালাস নদীর যুদ্ধে বিজয়ের পরে এই বইগুলি কাগজ নামে পরিচিত একটি চীনা উদ্ভবন এর উপর লেখা হয়েছিল। এ সময় অতি শীঘ্রই, বাগদাদের বেশিরভাগ লোক সাক্ষর এবং লেখালেখিতে সুপরিচিত হয়ে ওঠে এবং দিনে দিনে বাগদাদ নগরী আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে।
হালাকু খানের বাগদাদ উদ্দেশ্যে গমন
বাগদাদের পূর্ব দিকে, ইতিমধ্যে, তেমুজিন/চেঙ্গিস খান নামে এক যুবক যোদ্ধা মঙ্গোলদের একত্রিত করতে শুরু করেন এবং চেঙ্গিস খান উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তার নাতি হালাকু খান, যিনি মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সীমানাগুলিকে ইরাক এবং সিরিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
হালাকু খানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পারস্যের ইলখানাত কে মঙ্গোল শাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষে, তিনি প্রথমে আততায়ি নামে পরিচিত ধর্মান্ধ শিয়া গোষ্ঠীটিকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করেছিলেন এবং পারস্যে তাদের পর্বতমালার দুর্গটি ধ্বংস করে দিয়ে আব্বাসীয়দের বন্দী করার লক্ষে দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকেন।
সে সময় বাগদাদে আব্বাসিয় খলিফা মুস্তাসিম মঙ্গোলদের অগ্রযাত্রার গুজব শুনেছিলেন, তবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে প্রয়োজন হলে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব তার শাসককে রক্ষা করতে তার পাশে এসে দাঁড়াবে।
তবে, সুন্নি খলিফা তাঁর শিয়া প্রজাদেরকে এর কিছুদিন আগেই অপমান করেছিলেন এবং সে জন্য শিয়া গ্র্যান্ড উইজিয়ার আল-আলকামজি, মঙ্গোলদের দুর্বল নেতৃত্বকে আব্বাসিয় খিলাফত আক্রমণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে মুস্তাসিমের সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
যদিও ১২৫৭ এর শেষদিকে, হালাকু খান, মুস্তাসিমকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন যাতে তিনি বাগদাদের ফটকগুলি মঙ্গোল এবং তাদের খ্রিস্টান জর্জিয়ান মিত্রদের জন্য খুলে দেওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু মোস্তাসিম জবাব দিয়েছিল, মঙ্গোল নেতাকে সেখান থেকে ফিরে যাওয়া উচিত।
এরপর হালাকু খান প্রচন্ড রাগান্বিত হন এবং তার শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে আব্বাসীয়দের রাজধানী বাগদাদকে ঘিরে ফেলার আদেশ দেন। এ সময় আব্বাসিয় খলিফা মুস্তাসিম, শান্তি প্রস্তাব নিয়ে মঙ্গোলদের নিকট তার সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে প্রেরণ করেন। কিন্তু হালাকু তাদের সাথে দেখা করতে আসা প্রতিনিধি দলের সকল সদস্যকে হত্যা করেন।
মঙ্গোলদের আক্রমণ এবং বাগদাদ দখল
আব্বাসিয়দের অবরোধ এভাবে আরও বার দিন ধরে চলে, কিন্তু তারা মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে পারেনি। ১৩ তম দিনে বাগদাদ শহরের প্রাচীরগুলোর পতন হয়। বাগদাদ নগরীতে শেষ পর্যন্ত মঙ্গোলরা প্রবেশ করে এবং মঙ্গোল ও তাদের জর্জিয়ান মিত্রদের দ্বারা কয়েক লক্ষ বাগদাদবাসীকে হত্যা করা হয়। বায়ত আল-হিকমাহ বা উইজডম লাইব্রেরীর বইগুলি টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেয়া হয়, ধারণা করা হয়েছিল যে নদীতে এতো বই ফেলা হয়েছিলো যে, সেখানে বইয়ের একটি অস্থায়ী সেতু তৈরি হয়ে যায় যাতে অনেকগুলো ঘোড়া তাদের উপর দিয়ে নদী পেরিয়ে যেতে পারত।
খলিফার কাঠের সুন্দর প্রাসাদটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এবং এ সময় খলিফা নিজেই তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছিলেন অর্থাৎ আত্মহত্যা করেন। মঙ্গোলরা বিশ্বাস করত রাজকীয় রক্ত ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাই কেবলমাত্র নিজেদের নিরাপদে রাখার জন্য, তারা মোস্তাসিমের দেহটিকে একটি গালিচায় জড়িয়ে, তাদের ঘোড়াগুলিকে মৃতদেহের উপরে চড়িয়ে, পদদলিত করে।
বাগদাদ নগরীর পতন এর সাথে সাথে আব্বাসীয় খিলাফতের সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়। এবং এর মাধ্যমে মধ্য প্রাচ্যে মঙ্গোলদের বিজয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল এটি।
একইসাথে প্রায় শতাব্দি ব্যাপী ইসলামিক সাহিত্য, সংস্কৃতির পিঠস্থান হিসেবে পরিচিত বাগদাদের পতন ঘটে। মঙ্গোলদের এ আক্রমণ শুধুমাত্র আব্বাসিয় বংশের ধংসই ডেকে আনেনি, সাথে সাথে ইসলামের ইতিহাসের অমর সৃষ্টি গুলকেও ধ্বংস করা হয় এবং শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস হারিয়ে যায় চিরজীবনের জন্য।
তথ্যসুত্রঃ- https://www.thoughtco.com/
https://en.wikipedia.org/