নতুনভাবে নির্বাচিত পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য (যেভাবে তালিকটি চূড়ান্ত করা হয়েছিলো)

নতুনভাবে যে প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন করা হয়

আপনি হয়তো পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য স্থাপনাগুলি সম্পর্কে অবগত আছেন। তবে এ সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের পেছনে যে একটি মহৎ উদ্যোগের বিষয় জড়িত আছে সেটা কি জানেন? সুইস চলচিত্র প্রযোজক এবং উদ্যোক্তা বার্নার্ড ওয়েবার ২০০৭ সালে একটি মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 

পৃথিবীর হাজার হাজার স্থাপনা রয়েছে এবং এ স্থাপনা গুলোর পেছনে যে জানা অজানা ইতিহাস রয়েছে সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি শীর্ষ কিছু স্থাপনাকে বেছে নেয়ার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রতিটা সাইট সম্পর্কে যথেষ্ট পর্যালোচনা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ যাতে তাদের মতামত প্রদানের মাধ্যমে একটি নতুন তালিকা তৈরি করতে পারেন সে বিষয়ে বিশ্বব্যাপী ভোটদান প্রচারের বাবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তিনি।

প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য তালিকার বিপরীতে, নতুনভাবে নির্বাচিত পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য তালিকায় বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চল থেকে প্রাচীন এবং আধুনিক উভয় কাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তার মাধ্যমে তিনি তার কার্যক্রম শুরু করেন ।

সে লক্ষে, শতাধিক সুপারিশ থেকে স্থপতি জাহা হাদিদ, তাডাও আন্দো, সিজার পেলি এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ বিচারকগণ চূড়ান্তভাবে ২১ টি স্থাপনাকে বেছে নিয়েছিলেন। তারপরে, বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন ভোটার তাদের ভোট প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা সাতটি নতুন ওয়ান্ডার্স বেছে নিয়েছে।

২০০৭ সালের ৭ জুলাই পর্তুগালের লিসবনে ওয়ার্ল্ডের নতুন সপ্তাশ্চর্য ঘোষণা করা হয়েছিল। নিচের আলোচনা থেকে আমরা সপ্তাশ্চর্য স্থাপনা গুলি সম্পর্কে জানতে পারব এবং আরও জানবো যে, কোন কোন স্থাপনাগুলি এখানে স্থান পেয়েছিল।

০১। মেক্সিকোর ইউকাটেনে অবস্থিত “ চিচেন ইতজা ”

চিচেন ইতজা, মেক্সিকো

চিচেন ইতজা মেক্সিকোর ইউকাটেন রাজ্যে/উপদ্বীপে অবস্থিত মায়া সভ্যতার একটি নিদর্শন। ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিকশিত হওয়া মায়া সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন এ স্থাপনা। প্রাচীন মায়ানরা ইউকাটেন উপদ্বীপে চিচেন ইতজায় অদ্ভুত কিছু মন্দির, প্রাসাদ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল।

উত্তর ইউকাটেন উপদ্বীপের উপকূল থেকে প্রায় ৯০ মাইল দূরে অবস্থিত, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটিতে মন্দির, প্রাসাদ এবং কুয়াসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। পুরো চিচেন ইতজার আসলে দুটি অংশ রয়েছে, প্রথমটি প্রাচীন শহর যা ৩০০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল এবং নতুন শহরটি ৭৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মায়ান সভ্যতার প্রান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

মূলত স্প্যানিশদের আমেরিকা অবিস্কারের মধ্যদিয়ে  চিচেন ইতজার পতন ঘটে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের পর থেকে প্রচুর সম্পদের লোভ এবং নতুন উপনিবেশ গড়ে তোলার লক্ষে স্প্যানিশদের এখানে আগমনের পর থেকেই মূলত মায়া সভ্যতার পতন হয় এবং এভাবেই হারিয়ে যায় চিচেন ইতজা।

এটি ইউনেস্কোর একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং বিশ্বের এক নতুন আশ্চর্য হওয়ার জন্য সারা পৃথিবী থেকে এর পক্ষে ভোটে পরে এবং এটি নির্বাচিত হয়।

০২। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অবস্থিত “ক্রিস্ট দা রেডিমার” স্ট্যাচু।

ক্রিস্ট দা রেডিমার, রিও ডি জেনিরো, ব্রাজিল

সপ্তাশ্চর্যর তালকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে ক্রিস্ট দা রেডিমার স্ট্যাচু। এটি মূলত যিশুখ্রিষ্টের একটি আর্ট ডেকো মূর্তি যা ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরের করকোভাডো পর্বতের শীর্ষে অবস্থিত।

এটি সম্পূর্ণ ব্রাজিলের গর্ব হিসেবে দাড়িয়ে আছে এবং স্ট্যাচুটি দেখলে মনে হবে যেন  রিও ডি জেনিরো শহরটিকে দুই হাত দিয়ে আগলে রেখেছে।

ফরাসী ভাস্কর পল ল্যান্ডোস্কি এবং ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার অ্যালবার্ট ক্যাকোটের সহযোগিতায় ব্রাজিলিয়ান ইঞ্জিনিয়ার হিটার দা সিলভা কস্তা এটি নির্মাণ কাজ শুরু করেন ১৯২২ সালে।

৩০ মিটার উচ্চতার এ মূর্তিটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৩১ সালে। ৬৩৫ টন ওজনের এ স্ট্যাচুর প্রতিটি হাতের দৈর্ঘ্য ২৮ মিটার। 

খ্রিস্ট ধর্মের প্রতীক, এই মূর্তিটি রিও ডি জেনেরিও এবং ব্রাজিল উভয়েরই সংস্কৃতির আইকনে পরিণত হয়েছে।

এটি বিশ্বের নিউ ওয়ান্ডার্স হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং ইউনেস্কোর একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।

৩। “কলোসিয়াম”, রোম, ইতালি।

কলোসিয়াম”, রোম, ইতালি

ইতালির রোমের প্রান কেন্দ্রে অবস্থিত কলোসিয়াম, ইউনেস্কোর একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং সেই সাথে নির্বাচিত ২১ টি স্থাপনার মধ্যে সেরা সাতের মধ্যে রয়েছে। খৃষ্টপূর্ব ৭২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ভেস্পাসিয়ানের অধীনে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল কলোসিয়ামের এবং তাঁর উত্তরসূরি তিতের অধীনে ৮০ খ্রিস্টাব্দে কলোসিয়ামের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছিল।

সে সময়ের সবচেয়ে বড় অ্যাম্পিথিয়েটার ছিল এটি এবং এর ধারন ক্ষমতা ছিল ৫০,০০০। শত শত শতাব্দী ধরে কলোসিয়াম তার বিভিন্ন সংস্কারকালে পর্যায়ক্রমে আনুমানিক ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ দর্শক ধারণ করতে সক্ষম হয় এবং এখানে গড়ে প্রায় ৬৫,০০০ দর্শক নিয়মিত উপস্থিত হতো।

নির্মাণের শুরুতে এখানে শুধুমাত্র গ্ল্যাডিয়েটর প্রতিযোগিতা চলতো, ধীরে ধীরে এর কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়।

পশু শিকার, মৃত্যুদণ্ড, বিভিন্ন বিখ্যাত যুদ্ধের প্রদর্শনী এবং শাস্ত্রীয় পুরাণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হতো এখানে। ভুমিকম্পসহ বিভিন্ন আক্রমনে এটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এর ঐতিহাসিক মর্যাদা কখনো ক্ষুন্ন হয়নি। এটি রোমের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ।

০৪। চীনের “ মহাপ্রাচীর ”

চীনের “ মহাপ্রাচীর

সম্রাট কিন শি হুয়াং খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে চীনের মহাপ্রাচীরের কাজ শুরু করেন এবং খ্রিস্টীয় ১৬শ শতকে মিং রাজবংশ এটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। প্রায় ৬০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রাচীরটি বহিঃ শক্তির হাত থেকে  চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়।

তবে গ্রেট ওয়াল আসলে কোনও একক দেয়াল নয়, বরং এটি কয়েকটি সতন্ত্র দেয়ালের সমষ্টি। বিভিন্ন স্থানে, বিশাল এ প্রাচীরগুলি ২৯.৫ ফুট (৯ মিটার) পর্যন্ত প্রশস্ত। বিভিন্ন রাজবংশ দ্বারা নির্মিত এ সীমানা প্রাচীরের একাধিক ভাগ রয়েছে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এ মহা প্রাচীরের দৈর্ঘ্য আসলেই অনেক বেশি।

গ্রেট ওয়াল এর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা সাধারণত ইতিহাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হিসাবে স্বীকৃত। বলা হয়ে থাকে, মহাকাশ থেকেও নাকি এ প্রাচীরের অবয়ব দেখা যায়। মানুশ নির্মিত এ স্থাপনাটি স্বাভাবিকভাবেই সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম।

০৫। “ মাচু পিচু ”, পেরু

মাচু পিচু ”, পেরু

পেরুর উরুবাম্বা উপত্যকার উপরে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত মাচু পিচ্চু, ১৫ শতকের ইনকা সভ্যতার একটি নিদর্শন। এটিকে ইঙ্কাদের হারানো শহর বলা হয়ে থাকে। দুটি পাহাড়ের চূড়ার মাঝখানে একটি ছোট স্থানে নির্মিত শহর মাচু পিচু।

সুন্দর এবং প্রত্যন্ত, ভবনগুলি সূক্ষ্মভাবে কাটা সাদা গ্রানাইট ব্লক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। দক্ষিন আমেরিকার ইনকা সভ্যতার ইতিহাস ছিল অত্যন্ত সল্প সময়ের। ইনকা সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় ১৪৫০ সালের দিকে, কিন্তু এর মাত্র একশ বছর পর স্পেনের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে।

স্থানটি বেশ দুর্গম হওয়ায় বেশ কয়েকশ বছর ধরে অজ্ঞাত থাকার পর  ১৯১১ সালের ২৪ জুলাই আমেরিকান এক্সপ্লোরার হীরাম বিঙ্গহাম এর মাধ্যমে পেরুভিয়ান পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত মাচু পিচু সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। দক্ষিন আমেরিকার ইনকা সভ্যতার এ শহরটি সপ্তাশ্চর্যের একটি।

০৬। ভারতের আগ্রার “ তাজমহল ”

আগ্রার “ তাজমহল

প্রায় ২০,০০০ শ্রমিকের ২২ বছর ধরে নির্মিত, উজ্জ্বল সাদা আইভরি মার্বেল পাথরের অপূর্ব এ স্থাপনাটি মোঘল শাসন আমলের অপূর্ব কীর্তি। সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় স্ত্রীর জন্য একটি সমাধি হিসাবে নকশা করা এ সমাধিটি ১৬৪৮ নির্মাণ শেষ হয়।

মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এবং  বিশ্বের নিউ ওয়ান্ডার্স হিসাবে তালিকাভুক্ত।

০৭। ” পেট্রা নগরী “, জর্দান

পেট্রা নগরী “, জর্দান

নাবাতাইন কারওয়ান সিটি, জর্ডানের একটি প্রাচীন মরুভূমি শহর যা পেত্রা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ধারনা করা হয় ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল নাবাতাইন (যাযাবর আরবদের নাবাতায়িন বলা হয়) রাজ্যের রাজধানী। বাণিজ্যর মাধ্যমে নাবাতাইনরা যথেষ্ট সম্পদের মালিক হয় এবং পেট্রা তাদের সম্পদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

৩১২ খ্রিস্টপূর্ব শহরটিতে গ্রিকদের দ্বারা একটি ব্যর্থ আক্রমণ হয়। তার পর থেকে এটি মূলত একটি সুরক্ষিত দুর্গ নগরী হিসেবে গড়ে ওঠে। 

 

তথ্যসূত্রঃ- https://www.travelchannel.com/interests/outdoors-and-adventure/articles/new-seven-wonders-of-the-world

https://en.wikipedia.org/wiki/New7Wonders_of_the_World

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top