আপনি যদি একটু গভিরভাবে বর্তমান পারমানবিক বিশ্বের কথা চিন্তা করেন, তবে এর কোন কুল কিনারা আপনি খুজে পাবেন না। নিউক্লিয়ার বোম সম্পর্কে এই নিবন্ধে আমি আপনাদের এমন কিছু তথ্য দিতে চলেছি , যা থেকে শুধু চমকে ওঠা ছাড়া আপনার আর কোন উপায় থাকবে না।
পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রথম ধাপ

আমেরিকার নিউ মেক্সিকো মরুভূমিতে চালানো প্রথম পারমানবিক পরিক্ষা এবং হিরোশিমা , নাগাসাকিতে মানুষের উপর চালানো পারমানবিক পরিক্ষার পর থেকে এই অস্ত্রগুল আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অনেক টা আমাদের কোরবানির গরু কেনার মত অবস্থা বলতে পারেন। কে কার থেকে কত বড় এবং কত বেশি শক্তিশালী বোমা তৈরি করবে, সেই নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিলো অনেক আগে থেকেই এবং দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিযোগিতা ক্রমান্বয়ে বেরেছে।
১৯৪৫ সালে ১৬ জুলাই আমেরিকার নিউ মেক্সিকোতে “ম্যানহাটন পরজেক্টের” আওতায় চালানো প্রথম পারমানবিক পরিক্ষার পর থেকে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ২৪৭৫ টি পারমানবিক পরিক্ষা চালানো হয়েছে (মতান্তরে কিছু কম বেশি হতে পারে)। যার ৮৫% এর বেশি পরিক্ষা চালিয়েছে মাত্র দুটি দেশ। আমেরিকা এবং রাশিয়া (প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন)। এ দুটি দেশ শুধু নিজেরাই ২১১৩ বার পারমানবিক পরিক্ষা চালিয়েছে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ১১৩২ বার এবং রাশিয়া ৯৮১ বার পারমানবিক অস্ত্রের পরিক্ষা চালায়। তবে মানব জাতির জন্য সৌভাজ্ঞের বিষয় হল, শুধু মাত্র দুটি বিস্ফোরণ সরাসরি মানুষ হত্যা করার জন্য ব্যবহার করা হলেও, বাকিগুলো শুধুই পরীক্ষা ছিলো।
হিরোশিমা এবং নাসাকিতে ব্যাবহারকৃত পারমাণবিক বোমা

আমরা অনেকেই জানি, আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট পারমানবিক বোমার বিষ্ফোরন ঘটায়। কিন্তু বর্তমানের তুলনায় এই দুটি বমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল অনেক কম। হিরশিমায় বিস্ফরিত হওয়া বোমাটির ক্ষমতা ছিল মাত্র ১৫ কিলটন (মাত্র কেন বলছি, সেটা ধিরে ধিরে বুঝতে পারবেন)। ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে বিস্ফরিত হওয়া বোমাটি ছিল ২১ কিলোটনের। এই ১৫+২১= ৩৬ কিলটনের বোমা কত জন মানুষের প্রান নিয়েছিলো জানেন? প্রায় দের লক্ষ মানুষের।
পারমানবিক অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা

পারমানবিক অস্ত্র কত বড় এবং কত ভয়ঙ্কর হতে পারে? সে বিষয়ে আমাদের অনেকেরই খুব একটা জানা নেই। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না, বর্তমান সময়ের বোমাগুলো কত বেশি ভয়ঙ্কর এবং বড় হতে পারে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রাগারে সবচেয়ে বড় যে অস্ত্রটি রয়েছে তার নাম হল বি৩৮ বোমা, যা ১.২ মেগাটনের বিস্ফোরণ তৈরি করতে পারে। আমরা যদি হিরোশিমার বিস্ফরনের কথা চিন্তা করি তবে সেটা ছিল ১৫০০০ টিএনটির সম ক্ষমতার, কিন্তু বি৩৮ এর বিস্ফোরণের ক্ষমতা ১.২ মেগাটন = ১২ লক্ষ টন। অর্থাৎ হিরোশিমায় বিস্ফরিত হওয়া বোমা থেকে বি৩৮, ৮০গুনের বেশি বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। এবার ভাবেন বিশয়টা কেমন হবে, যদি বর্তমানে কোন জনবহুল এলাকায় এরকম বিস্ফোরণ ঘটে। আপনি হিরশিমার বিষ্ফোরণকে একটি ব্যাঙের ছাতার মত দেখলে, বি৩৮ এর বিস্ফরনের জন্য আপনাকে মানুষের মাথার উপরে ধরে রাখা ছাতাটির কথা চিন্তা করতে হবে। এই বোমাটির শক অয়েভের উচ্চতা এয়ার লাইনগুলোর স্বাভাবিক উচ্চতা থেকেও অনেক বেশি।
এবার আসছি ক্যাসল ব্রাভো বমার কথায়। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী পারমানবিক পরিক্ষা ছিল ক্যাসল ব্রাভো পারমানবিক বোমার পরিক্ষা। ১৯৫৪ সালের ১ মার্চ চালানো এই পরিক্ষার ক্ষমতা ছিল ১৫ মেগাটনের বেশি, হিরশিমার বিস্ফোরণের সাথে তুলনা করলে, তার থেকে ক্যাসল বোমার বিষ্ফোরনের ক্ষমতা ছিল ১০০০ গুন বেশি। কিন্তু মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পারমানবিক অস্ত্রের পরিক্ষা চালানো তখনো বাকি ছিল। ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন টেসার বোমা নামে এক অতি মানবিয় পারমানবিক বোমার পরিক্ষা চালায়। রাশিয়ার উত্তরের অঞ্চল নভায়া জেল্মায়ায় ৫০ মেগাটনের একটি বিস্ফোরণ ঘটে সে সময়। যা ৩,৩৩৩ টি হিরোশিমার বিস্ফোরণের সমপরিমান শক্তি উতপাদন করেছিলো।
বিস্ফরন্টি এতোটা শক্তিশালী ছিল যে, সেই অঞ্চল থেকে অনেক দূরে অবস্থিত নরওয়ে, ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন বিল্ডিঙয়ের জানালার কাচ ভেঙ্গে গিয়েছিলো, বিষ্ফোরনে সৃষ্ট শক ওয়েভের প্রভাবে। এবং টেসার বোমার শক অয়েভ প্রায় সারা প্রিথিবিকেই প্রকম্পিত করেছিলো।
থিওরিটিকাল টেসার বোমা

যদিও পরিক্ষা করা হয়নি এমন একটি পারমানবিক বোমার চিন্তা রাশিয়ান্দের মাথায় ছিল, যার নাম দেয়া হয়েছিলো থিওরিটিকাল টেসার বোমা। টেসার বোমার থেকে দিগুন শক্তিশালী এই বোমা তৈরির পরিকল্পনা খুব ভালো ভাবেই এগিয়ে জাচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ১০০ মেগাটনের বোমাটি রাশিয়া আর তৈরি করেনি। আসলে ৫০ এবং ৬০ এর দশকের এই পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা মূলত দুটি দেশের মধ্যে চলমান কোল্ড ওয়্যারের কারনেই তৈরি হয়েছিলো, এবং বলা হয়ে থাকে সাম্প্রতিক ইতিহাসে পৃথিবী সে সময় সবচেয়ে ঝুকিতে ছিল।
এই বোমাগুলোর বিস্ফোরণের পরিধিকে আপনি শুধু চিন্তাই করতে পারেন। টেসার বোমার বিস্ফরন্টি যদি আপনি মহাকাশ থেকে দেখতে যান তবে দেখবেন, পৃথিবীর একটি বিস্ত্রিন অঞ্চল এই বোমার বিস্ফরনে ধংস হয়ে গিয়েছে। এতো গেল অস্ত্র পরিক্ষার প্রতিজগিতা। কিন্তু আপনার মনে একটা প্রশ্ন জাগছে যে বর্তমানে পৃথিবীতে কতগুল পারমানবিক বোমার অস্তিত্ত রয়েছে?
বর্তমানে পৃথিবীতে পারমানবিক বোমার সংখ্যা

বর্তমানে পৃথিবীতে ১৫৬০০ অধিক পারমানবিক বোমা রয়েছে। যা দিয়ে পুরো পৃথিবীকে কয়েক ডজন বার ধংস করে দেয়া সম্ভব। মাত্র ৯ টি দেশ এই বিপুল পারমানবিক অস্ত্র সম্ভারের নিয়ন্ত্রন করে। এর মধ্যে আমেরিকার হাতে রয়েছে ৭৩০০ টি এবং রাশিয়ার হাতে রয়েছে ৯৬৭০ টি বোমা। যা মোট পারমানবিক বোমার ৯২%। ভাবা যায়।
বাকি ৮% বোমা রয়েছে অবশিষ্ট ৭ টি দেশের হাতে। যার মধ্যে ফ্রান্স, চীন, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান , ভারত, ইজরায়েল এবং উত্তর করিয়া হাতে রয়েছে যথাক্রমে ৩০০,২৬০,২১৫,১২৫,১১৫, ৬০-৪০০ এবং ৯ টি। তবে ইস্রায়েল তার পারমানবিক কর্মসূচিকে খুবই গোপন রেখেছে। এবং দেশটি তাদের পারমানবিক অস্ত্রের কথা কখনো স্বীকার বা অস্বীকার কিছুই করে না। বিষয়টি এমন যে, সবাই জানে যে ইজ্রায়েলের কাছে আছে কিন্তু এর কোন প্রমান নেই। মরডেচাই ভানু নামে এক বাক্তি ইজ্রায়েলের পারমানবিক কর্মসূচি সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন, যার জন্য তাকে ১৮ বছর কারাবাসে কাটাতে হয়েছিলো। ১১ বছর ছিল নিরজন কারাবাস। এবার আশাকরি বুঝতে পারছেন কেন ইজ্রায়েলের এই বিষয়টি এতদিন গোপন থেকেছে।
মজার এবং অবাক করা তথ্য হল, দক্ষিন আফ্রিকা এক সময় ৬ টি পারমানবিক অস্ত্রের অধিকারি ছিল। কারণ ছিল বর্ণবাদি সরকার নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। সে সময় ৭৯% মানুষের কোন ভোটাধিকার ছিলনা। এবং কমিউনিস্টরা এদের উৎখাত করার চেস্টা করেছিলো। তবে পরবর্তীতে দক্ষিন আফ্রিকা এগুলকে ধংস করে দেয়। দক্ষিন আফ্রিকাই একমাত্র দেশ যারা, পারমানবিক অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জন করার পরেও নিজেরা সেচ্ছায় সেগুলো ধ্বংস করেছিলো।
শুধু কি দক্ষিন আফ্রিকা? না আপনি যদি এভাবে চিন্তা করেন তবে ইউক্রেন, বেলারুশ এবং কাজাকস্তানও কিন্তু বিপুল পরিমানে পারমানবিক অস্ত্রের অধিকারি ছিল। তবে সেটা ১৯৯১ সালের আগে। শুধুমাত্র ইউক্রেনেই ৫০০০ এর বেশি পারমানবিক অস্ত্র মজুত ছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরে ইউক্রেন রাশিয়াকে এই সব পারমানবিক অস্ত্র দিয়ে দিতে সম্মত হয়। যদি সেগুলো এখন ইউক্রেনের হাতে থাকতো তবে দেশটি হয়তো পৃথিবীর ২য় বা ৩য় বৃহত্তম পারমানবিক অস্ত্রে সক্ষম দেশ হিসেবে পরিচিত হতো।
বন্ধুরা এতো কিছুর পরেও আমরা কিন্তু একটা দেশের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছি। ঠিক ধরেছেন আমি ইরানের কথাই বলছি, না না ইরান এখনো পারমানবিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তবে খুব শিঘরই হয়তো আমরা ১০ম পারমানবিক অস্ত্রধারি দেশটিকে দেখতে চলেছি।