আপনি যদি অতীত ইতিহাস ঘাটতে পছন্দ করেন তবে চীনের কিছু আবিষ্কার আপনাকে বেশ আগ্রহী করে তুলবে, এটা বললে মনে হয় খুব একটা ভুল হবে না। প্রাচীন চীনাদের এমন কিছু আবিষ্কার রয়েছে যা আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি।
১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শ্যাং রাজবংশ থেকে চিং রাজবংশ সময় পর্যন্ত অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয় এবং তাদের এর কৃতিত্ব দেওয়া হয়। পৃথিবীতে অনেক বেশি ব্যাবহার হয় এমন বেশকিছু আবিষ্কারের সাক্ষী মূলত বর্তমান চীনের পূর্ব পুরুষগণ। আজ আমরা এমন বেশ কিছু চীনা আবিষ্কার সম্পর্কেই জানতে চলেছি।
১। চা (Tea)।
চায়ের সংজ্ঞা হয়তো আমরা সবাই জানি, তারপরেও এভাবে বলতে গেলে বলা যায়, সাধারণত পূর্ব এশিয়ার চিরসবুজ ঝোপঝাড় (গুল্ম) এর দেশীয় শব্দার্থ অর্থাৎ ক্যামেলিয়া সিনেনেসিসের পাতা দিয়ে গরম বা ফুটন্ত জলে প্রস্তুত করা এমন একটি সুগন্ধযুক্ত পানীয় হল চা ।
পানীয় জলের পরে, চা হল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পানীয়। চা-এর উদ্ভব শ্যাং রাজবংশের সময়ে। চা আবিষ্কারের একটি মজার কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট শেন নুং যখন একটি কাপে করে জল পান করছিলেন তখন একটি ক্যামেলিয়া গুল্ম উড়ে এসে তার জলের কাপে পড়েছিল।
মূলত তখন থেকেই চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে একে আলাদা ধরেনের ঔষধি পানীয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
চা শব্দটি যেখান থেকেই উদ্ভব হোক না কেন এটি যে, ক্যামেলিয়া সিনেনসিস জাতীয় উদ্ভিদ, সে বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চা কে একটি নতুন পানীয় হিসাবে বিবেচিত করা হয়েছিল। চীনা তাং রাজবংশের সময়ে এটি একটি বিনোদনমূলক পানীয় হিসাবে জনপ্রিয়তা পায় এবং চা পান করার বিষয়টি পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
পর্তুগিজ যাজক এবং বণিকরা ষোড়শ শতাব্দীতে এটি ইউরোপে নিয়ে এসেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে, ব্রিটিশদের মধ্যে চা পান করা কেতাদুরস্ত ভাব হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে, এবং এই ব্রিটিশরাই ভারতে এই গাছটির বৃহত আকারে উত্পাদন শুরু করে এবং বাণিজ্যিকীকরণ শুরু করে। আর এভাবেই উপমহাদেশ এবং সারা বিশ্বে চায়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে চীন এবং ভারত বিশ্বের ৬২% চা সরবরাহ করেছিল।
গানপাউডার নবম শতাব্দীতে চীনে আবিষ্কৃত হয়েছিল। সে সময় এক রসায়নবিদ সল্ট্পিটার, সালফার এবং কাঠ কয়লার ধূলিকণা মিশ্রিত করে এটা আবিষ্কার করে, প্রথমে গানপাউডারকে বাঁশের নলের মাধ্যমে ব্যাবহার করা হতো। ১৩তম শতাব্দীর শেষে ইউরেশিয়ার বেশিরভাগ অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
চীনের বিশ্বয়কর আবিস্কারটি ভাল কাজের বিপরীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবন সংহারের জন্য ব্যাবহার হচ্ছে।
৩। কম্পাস।
![](https://www.factsw.com/wp-content/uploads/2019/11/4925267732_8b4a2cf887_b.jpg)
কম্পাস একটি প্রাচীন চীনা উদ্ভাবন। কম্পাস হ’ল এমন একটি যন্ত্র যা নেভিগেশন ( দিক নির্ণায়ক যন্ত্রও ) এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য ব্যবহৃত হয়, এবং এটি ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কিত দিক প্রদর্শন করে। খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ সালে চীনা হান রাজবংশ এটি উদ্ভাবন করে।
প্রথমে, তারা একটি লডস্টোন কম্পাসটিতে ব্যবহার করেছিল। লোহা(আয়রন) অক্সাইডযুক্ত সূঁচটিও ভালভাবে কাজ করবে বুঝতে পেরে এটি উত্তর-দক্ষিণে নির্ধারণ করা হয়। মধ্যযুগের আগ পর্যন্ত জাহাজগুলোতে কম্পাস এর ব্যবহার করা হত না।
হান রাজবংশের আরেকটি অন্যতম আবিষ্কার ছিল কাগজ। চীনে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সিই হান কোর্টের নপুংসক ক্যা লুন কাগজ আবিষ্কার করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, চীন থেকে মধ্য প্রাচ্যের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে কাগজের জ্ঞান এবং ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে প্রথম জল চালিত কাগজ কলগুলি নির্মিত হয়েছিল।
৫। ভূমিকম্প সনাক্তকারী যন্ত্র।
![](https://www.factsw.com/wp-content/uploads/2019/11/Kinemetrics_seismograph.jpg)
হান রাজবংশের আরেকটি উদ্ভাবন হচ্ছে সিসমোস্কোপ বা সিসমোগ্রাফ। এ সিসমোগ্রাফটি ভু-কম্পন এবং তাদের উৎস বা দিক সনাক্ত করতে পারতো, তবে,এটি ভূমিকম্পের তীব্রতা সনাক্ত করতে তখনও সক্ষম ছিলনা। এ চীনা আবিষ্কারটি পরবর্তীতে মডিফাইড হয়ে ইতিহাসের অনেক বড় মাপের ভুকম্পন পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছে।
৬। চীনামাটির তৈরি বাসন।
জীবন রক্ষাকারী সিসমোগ্রাফ উদ্ভাবনের পরে চীনাদের আরেকটি নান্দনিক উদ্ভাবন ছিল চীনামাটির তৈরি বাসন আবিষ্কার। এটি ছিল কওলিন মাটির (চীনামাটি) দিয়ে তৈরি এক ধরণের মৃৎশিল্প। এই ধরণের সিরামিক উপাদান কীভাবে তৈরি করা যায়, তার আবিষ্কার সম্ভবত হান রাজবংশের সময়ে হয়েছিল।
তবে সাদা চীনামাটির বাসনগুলির পুরো প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিলো সম্ভবত ত্যাং রাজবংশের সময়। আজ চীনামাটির বাসন যেগুলো আপনার ডাইনিং, বাথরুমে এবং দন্তচিকিত্সায় দেখতে পান সেগুলর আঁতুড়ঘর মূলত চিনেই।
৭। আকুপাংচার, একধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি।
![](https://www.factsw.com/wp-content/uploads/2019/11/Flickr_-_Official_U.S._Navy_Imagery_-_Cmdr._Yevsey_Goldberg_conducts_an_acupuncture_procedure..jpg)
আকুপাংচার হল, ব্যথা ও রোগ নিরাময় করার জন্য ব্যবহৃত একধরনের চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি, যা অনেকেই হয়তো শুনে থাকবেন। এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে সরু সুই ফুটিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
চিনে চিকিৎসা পদ্ধতিটি আবিস্কৃত হলেও প্রথমদিকে এটি বিজ্ঞানের স্বীকৃতী পায়নি, তবে ২০০৩ সালে , ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশান (World Health Organization) আকুপাংচার কে স্বীকৃতি দেয়।