korean war

কোরীয় যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়া কিভাবে জড়িয়েছিল?

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই বিশ্ব আর একটি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে কোরীয় উপদ্বীপে। আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন পারস্পরিক স্নায়ু সংঘাত যে কি ভয়ানক পরিনতি ডেকে নিয়ে আসতে পারে তা উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া বাসি ভালো ভাবেই টের পেয়েছিল সে সময়।

অনেক ইতিহাস বিদ একটা বিষয় বিশ্লেষণ করেছেন, আসলে সে সময় কোরিয়ানদের কি লাভ হয়েছিলো যুদ্ধ থেকে?

বর্তমান সময়ে কি সেই যুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে খুব একটা ভালো অবস্থা বিরাজ করছে? যারা এ বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন তারা এর উত্তরটা নিশ্চই জানেন। তবে কোরীয় উপদ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতি আজ আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। 

১৯৫০ সালের জুন থেকে ১৯৫৩ সালের জুলাই পর্যন্ত কোরিয়ান উপদ্বীপে যে যুদ্ধ সংঘঠিত হয় তাতে দেখা যায় যে কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া তার দক্ষিণের গণতান্ত্রিক প্রতিবেশীকে আক্রমণ করেছে। হয়তো বিষয়টা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু আমরা কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলেছি।

ইউনাইটেড নেশনস এর সমর্থনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সজ্জিত সৈন্যবাহিনী নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়াকে সাহায্য করতে, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও লড়াই চালিয়ে যায় এবং এই যুদ্ধ ততক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো যতক্ষণ না পর্যন্ত উপদ্বীপ এর পরিবেশ  স্থিতিশীল হয়।

তীব্র একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল এটি, কোরিয়ান যুদ্ধে সারা বিশ্ব দেখেছিল পারস্পরিক স্বার্থের সংঘাত। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরীয় আগ্রাসন ঠেকাতে এবং কমিউনিজমের বিস্তার রোধে কাজ করার সাথে সাথে তার নিয়ন্ত্রণের নীতি প্রতিষ্ঠার চেস্টা চালিয়েছিল।

 

যুদ্ধের প্রেক্ষাপট

Seoul_Battle-_Korean_War

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপান থেকে মুক্তি পাবার পর মিত্রবাহিনী কোরিয়া উপদ্বীপকে ৩৮ তম অক্ষরেখায় বিভক্ত করে ফেলে। দক্ষিণে আমেরিকা এবং উত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

সেই বছর একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ দুটিকে পুনরায় একত্রিত করা হবে এবং স্বাধীনতা দেয়া হবে। কিন্তু এ সময়কালকে পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছিল এবং ১৯৪৮ সালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়াতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা সমর্থিত কিম ইল-সং উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা লাভকরে এবং যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত দক্ষিণ কোরীয় প্রার্থী সিঙ্গম্যান রি দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতা পায়। ক্ষমতা গ্রহণ করার সময়, দেশ দুটিতে দুই ধরণের শাসন ব্যাবস্থা পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া গণতান্ত্রিক ধারায় এবং উত্তর কোরিয়া কমিউনিজমের প্রতি আনুগত্য দেখায়।

উভয় দেশই তাদের নির্দিষ্ট আদর্শের অধীনে উপদ্বীপকে পুনরায় একত্রিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু আপনি যদি কোন একটা দড়ির দুই প্রান্ত ধরে টানতে থাকেন তবে এর দুটি মাথাকে কখনই একত্রিত করা সম্ভব নয়। এদের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছিল। বেশ কয়েকটি সীমান্ত সংঘর্ষের পরে, উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালের ২৫ জুন দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রমণ চালিয়ে সংঘাতের সূচনা করে।

 

উত্তর কোরিয়ার এ আক্রমণটির তাত্ক্ষণিকভাবে নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ একটি রেজোলিউশন পাস করে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য সামরিক সহায়তার আহ্বান হিসেবে কাজ করেছিল। জাতিসংঘের ব্যানারে রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুমান আমেরিকান বাহিনীকে কোরীয় উপদ্বীপে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

পুসানকে ঘিরে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, জাতিসংঘের কমান্ডার জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থার ১৫ ই সেপ্টেম্বর ইনচনে একটি সাহসী হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন।

পুসান থেকে একটি ব্রেকআউটের পাশাপাশি এই প্রতিরোধ উত্তর কোরিয়ার আক্রমণকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ফলে উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার গভীরে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকে। তবে জাতিসংঘের সেনা হস্তক্ষেপের বিষয়ে চীন একটি সতর্ক বার্তা দিয়েছিলো, তা সত্ত্বেও আমেরিকান বাহিনী (জাতিসংঘের সেনাবাহিনী) ক্রিসমাসের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ করার আশা করেছিল। 

 

কোরীয় যুদ্ধে চীনা হস্তক্ষেপ

যদিও যুদ্ধকালীন বেশিরভাগ সময় ধরেই চীনের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে কমান্ডার ম্যাক আর্থারকে সতর্ক করা হচ্ছিল, কিন্তু ম্যাক আর্থার এসব হুমকি প্রত্যাখ্যান করেন। উত্তর কোরিয়াকে সমর্থন জানিয়ে চীনা বাহিনী ইয়ালু নদী পেরিয়ে কোরীয় যুদ্ধে প্রবেশ করে।

পরে তারা একটি বিশাল আক্রমণ চালিয়েছিল যা ইউএন বাহিনীকে দক্ষিণে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। তারা সিওলের দক্ষিণে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ম্যাকআর্থার এই অবস্থাটি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন এবং সার্বিক পরিবেশ স্থিতিশীল করতে সক্ষম হন এবং ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাল্টা আক্রমণ করেন। মার্চ মাসে তিনি সিওল পুনরায় দখল করেন। 

 

কোরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি

American_Solders

মার্কিন সেনা বাহিনী ৩৮ তম সমান্তরাল রেখায় থেমে গেলে যুদ্ধ কার্যকরভাবে অচলাবস্থায় পরিণত হয়।  ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে পানমুনজোমে যাওয়ার আগে ক্যাসং-এ আর্মিস্টিস একটি আলোচনার সূচনা করেন। এ সময় অনেক উত্তর কোরিয়ান নাগরিক (যারা দক্ষিনে যুদ্ধ করতে এসেছিল) এবং চাইনিজ বন্দী দেশে ফিরতে চাননি বলে এই আলোচনায় পাউ সম্পর্কিত ইস্যুতে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল।

অন্যদিকে, যখন মাটিতে আক্রমণ বাবস্থা তুলনামূলকভাবে সীমিত ছিল, তখন জাতিসংঘের বিমান বাহিনী শত্রুদের উপর প্রচন্ড আক্রমন চালিয়ে যেতে থাকে । এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই, উত্তর কোরীয় এবং চীনা সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পরে।

এই সময়ে, ব্যাটলস অফ হার্টব্রেক রিজ (১৯৫১), হোয়াইট হর্স যুদ্ধ (১৯৫২), ট্রায়াঙ্গল হিল যুদ্ধ (১৯৫২) এবং পোরক চপ হিল যুদ্ধ (১৯৫৩) সংঘটিত হয়।

 

১৯৫৩ সালে উপদ্বীপের মধ্যবর্তী গ্রাম হিসেবে পরিচিত  পানমুনজোমে আলোচনা শেষে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যদিও লড়াই শেষ হয়েছিলো, কিন্তু কোনও আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি হয়নি। পরিবর্তে, উভয় পক্ষই ফ্রন্ট বরাবর একটি অঞ্চল তৈরিতে সম্মত হয়েছিল। 

 

যুদ্ধের ক্ষতি

The rubble of Seoul

১৯৫৩ সালের ২৭শে জুলাই রাষ্ট্রপতি ডুইট আইজেনহওয়ার সম্মতি না দেয়া পর্যন্ত কোরিয়ান যুদ্ধ মুলত আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় নি। দুঃখের বিষয় হল, এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের বিশাল ক্ষতির পরেও উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রকৃত অরথেই কোন লাভি হয়নি।

কোরীয় যুদ্ধে  ৫৪,০০০ এরও বেশি আমেরিকান সৈন্য মারা গিয়েছিল। যা আমেরিকাদের জন্য ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পরে ছিল একটি বিশাল ধাক্কা। ১০ লক্ষেরও বেশি করিয়ান নাগরিক মারা যায়(সেনা সদস্য এবং সাধারন নাগরিক), অনেক চীনা নাগরিক তাদের প্রান হারায়।

 

তবে দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র সুত্রে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, যে পরিমান মানুষ সব মিলিয়ে কোরীয় যুদ্ধে নিহত হয়েছিলো, তার থেকেও বেশি মানুষ অদ্যাবধি নিখোঁজ রয়েছে, এবং ধারনা করা হয় যে এদের প্রায় সকলেই মৃত।

সুতরাং সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ কোরীয় যুদ্ধে মারা যায়। যুদ্ধে রাশিয়া কৌশলগতভাবে অংশ না নিলেও পেছন থেকে চীন এবং উত্তর কোরিয়াকে সাহায্য করেছিল।

শুধু এটাই নয়, আমেরিকা তার মোট সেনা বাহিনীর ৩১% সেনা সদস্যকে কোরীয় যুদ্ধে নিয়োজিত করেছিল, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে মোট ৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। চীন প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউয়ান ব্যয় করে (প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন ডলার)। ইউএসএসআর যে সহায়তা দিয়েছিলো তা কখনই হিসাব করা হয়নি।

 

তথ্যসুত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Korean_War

https://www.history.com/topics/korea/korean-war

https://www.britannica.com/event/Korean-War

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top