কাগজ আবিস্কারের পটভূমি
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যে কয়েকটি জরুরী জিনিসের প্রয়োজন হয়, তার মধ্যে অন্যতম হল কাগজ। কাগজবিহীন জীবন কল্পনা করার চেষ্টা করুন। এটা কি আদৌ সম্ভব? মনে হয় না। এমনকি ইমেল এবং ডিজিটাল বইয়ের যুগেও কাগজ আমাদের চারপাশে রয়েছে এবং এর ব্যাবহারের গুরুত্ব অতীতের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার অতিপ্রয়োজনীয় প্রাতঃরাশ সারা থেকে শুরু করে খবরের কাগজ, শপিং ব্যাগ, অর্থ, স্টোর রসিদ, সিরিয়াল বাক্স এবং টয়লেট পেপার সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে কাগজের ব্যাবহার অনস্বীকার্য। আমরা প্রতিদিন অনেক উপায়ে কাগজ ব্যবহার করি। তাহলে, আপনি একবারও ভেবেছেন এই অপূর্ব বহুমুখী উপাদানটি কোথা থেকে এসেছে? চলুন সেই উত্তরটি খোঁজার চেস্টাই করি।
প্রাচীন চীনা ইতিহাস থেক জানা গেছে, সিস লুন (বা কাই লুন) নামে এক নপুংসক/খোজা সর্ব প্রথম ১০৫ খ্রিস্টাব্দে কাগজ আবিষ্কার করেন এবং তিনি তৎকালীন হান রাজবংশের সম্রাট হেইদিকে সেটা উপস্থাপন করেছিলেন। তবে পশ্চিম চীন এবং তিব্বতের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে বোঝা যায় যে কাগজের আবিষ্কার বহু শতাব্দী আগেই হয়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের দিকে এ কাগজ চীনের প্রাচীন সিল্ক রোড শহরগুলির অন্যতম দুনুয়াং, খোতান এবং তিব্বতে আবিষ্কার হয়েছিল। এই জায়গাগুলির শুষ্ক জলবায়ু প্রথম আবিষ্কৃত এ কাগজকে পুরোপুরিভাবে পচন থেকে রক্ষা করে এবং এটি প্রায় ২ হাজার বছর অবধি ভালভাবেই সংরক্ষিত ছিল।
এই কাগজগুলি পরীক্ষা করে আশ্চর্যজনকভাবে একটা বিষয় উৎঘাটন হয়, কাগজের কিছু কিছু জায়গায় কালির চিহ্ন পাওয়া যায়, এতে ইতিহাসবিদদের ধারণা হয় যে, সে সময় প্রাচীন সিল্ক রোড এলাকায় তারা কাগজের পাশাপাশি কালিরও আবিষ্কার করেছিলেন।
চীনের প্রথম কাগজ তৈরি
চীনের প্রাথমিক কাগজ প্রস্তুতকারীরা কাগজ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে হেম ফাইবার (এক প্রকার শন জাতীয় উদ্ভিদ) ব্যবহার করত, যা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হত এবং কাঠের একটি বড় টুকরোর সাহায্যে ডুবিয়ে রাখা হতো। ফলস্বরূপ, এটি পাতলা তরলে রূপান্তরিত হলে সেটা একটি সমান্তরাল বাঁশের সাঁচে ঢেলে দেয়া হতো।
বাঁশের কাঠামোর উপরে শুকিয়ে যাওয়া তরল প্রাথমিকভাবে আলগা বোনা কাপড়টি ফাইবারের কাগজে রুপ নিত। এভাবেই মূলত কাগজ তৈরির প্রক্রিয়াটি করা হতো।
সময়ের সাথে সাথে, কাগজ প্রস্তুতকারীরা তাদের কাজের ক্ষেত্রে কিছু নতুনত্ব আনার চেস্টা করে। তারা এসময় কাগজ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বাঁশ, তুঁত এবং বিভিন্ন ধরণের গাছের ছাল সহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করা শুরু করে।
সরকারী রেকর্ড সংরক্ষনের জন্য একটি হলুদ পদার্থ কাগজ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাবহার করতো যা কাগজ কে ভিন্ন রঙ দিত, এই ইম্পেরিয়াল রঙের কাগজ অনেকদিন দীর্ঘস্থায়ী হতো, এবং এতেকরে কাগজকে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যেত।
প্রারম্ভিক কাগজের সাধারণ ফর্ম্যাটের মধ্যে একটি ছিল স্ক্রোল(রোল করা কাগজ)। একত্রে প্রস্তুতকৃত কাগজের বড় লম্বা টুকরোটিকে ছোট ছোট স্ক্রোল এ ভাগ করা হতো।
কাগজের প্রসার
চীনে প্রস্তুতকৃত কাগজের প্রচলন পরবর্তীতে বেশ প্রসার লাভ করে। কাগজ তৈরির ধারণা এবং প্রযুক্তি সমগ্র এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টীয় ৫০০ এর দশকে কোরিয়ান উপদ্বীপের কারিগররা চীনা কাগজ প্রস্তুতকারীদের মতো একই ধরণের উপকরণ ব্যবহার করে কাগজ তৈরি শুরু করেছিল। কোরিয়ানরাও কাগজ তৈরির ক্ষেত্রে ধানের খড় এবং সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করত।
কাগজ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রকারের ফাইবারের উদ্ভব হয়। প্রথম দিকে এ উপদ্বীপের প্রস্তুতকৃত কাগজ কোরীয় মুদ্রণের ক্ষেত্রেও ব্যাবহারের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে।
৬১০ সালের দিকে এক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, কোরিয়ান বৌদ্ধ ভিক্ষু ডন-চ, জাপানের সম্রাট কোটোকুর দরবারে কাগজকে পরিচিত করেছিলেন। এভাবে কাগজ তৈরির প্রযুক্তি, তিব্বতের পশ্চিমে এবং পরে দক্ষিণে ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। কাগজ তৈরির ধাতব যন্ত্রটির আবিষ্কারও হয়েছিলো এই উপদ্বীপে ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে ।
ইউরোপে কাগজের প্রচলন
৭৫১ সালে মধ্য প্রাচ্য এবং ইউরোপে কাগজ প্রথম পৌঁছায়। এ সময়, তাঙ্গ চিনের সেনাবাহিনী এবং ক্রমবর্ধমান আরবে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে তালাস নদীর পাশে (বর্তমানে কিরগিজস্তান) এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধে আরবরা বিজয়ী হয়।
আরবদের এই বিজয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, আব্বাসীয়রা টু হুয়ানের মতো মাস্টার পেপার-নির্মাতাসহ চীনা কিছু কারিগরদের বন্দী করে এবং তাদের মধ্য প্রাচ্যে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল।
সেই সময়, আব্বাসীয় সাম্রাজ্য পশ্চিম স্পেন এবং পর্তুগাল থেকে উত্তর আফ্রিকা হয়ে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ায় এই বিস্ময়কর নতুন আবিষ্কারের জ্ঞান আব্বাসীয়দের হাত ধরে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। পরবর্তীতে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই, সমরকান্দ (বর্তমানে উজবেকিস্তান) থেকে দামেস্ক এবং কায়রো পর্যন্ত কাগজ উৎপাদনের প্রসার ঘটে এবং প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
১১২০ সালে, স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ার মুরস শহরে ইউরোপের প্রথম পেপার মিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখান থেকে এই অদ্ভুত চীনা আবিষ্কারটি ইতালি, জার্মানি এবং ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে ছরিয়ে পড়ে। সেখান থেকেই, সিল্ক রোডের দুর্দান্ত এ এশিয়ান আবিস্কারটি ইউরোপের উচ্চ মধ্যযুগকে সারা বিশ্বে পরিচিত করতে সক্ষম করেছিল।
প্রাচীন চীনের এ আবিস্কারটি বহুল্ভাবে প্রচলিত হতে শুরু করে সাধারণত মধ্যযুগ থেকে। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পূর্ব এশিয়ায়, কাগজ বিপুল সংখ্যক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। বার্নিশের সাথে মিলিত হয়ে কাগজ এক নতুন সৌন্দর্য লাভ করে, এবং বিভিন্ন পাত্র এবং আসবাবপত্রে এর ব্যাবহার বেড়ে যায়।
জাপানে ঘরের দেয়ালগুলো প্রায়শই ভাত-কাগজ দিয়ে তৈরি করা হত। পেইন্টিং এবং বইয়ের পাশাপাশি কাগজ পাখা, ছাতা এমনকি উচ্চমানের কার্যকরি বর্ম তৈরির ক্ষেত্রেও ব্যাবহার করা হতো।
সর্বকালের অন্যতম দুর্দান্ত এশীয় আবিষ্কার কাগজ আজ সারা বিশ্বের কাছে অতি প্রয়োজনীয় বস্তু হিসেবে গ্রহণীয়। বর্তমান এ ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন সফটওয়্যার এর ব্যাবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও কোন ভাবেই কাগজের ব্যাবহার সেভাবে কমেনি। এবং ভবিষ্যতেও কাগজের ব্যাবহার অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়।
তথ্যসুত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_paper
https://www.thoughtco.com/