উত্তর এবং দক্ষিন করিয়া, প্রকৃতপক্ষে কিভাবে বিভক্ত হয়েছিল

কোরীয় উপদ্বীপের ইতিহাস

উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিন কোরিয়া পূর্ব এশিয়ার সার্বিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ ভুমিকা পালন করে চলেছে, এ কথাটি হয়তো অনেকেই স্বীকার করবেন। যদি আমরা পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস ঘাটি এবং এ অঞ্চলের অবস্থানগত গুরুত্তের কথা চিন্তা করি তবে আমাদের এর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে।

 

কোরিয় উপদ্বীপটি  খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে সিল রাজবংশ দ্বারা একত্রিত হয়েছিল, এবং জোসেওন রাজবংশের অধীনে অনেক শতাব্দী (১৩৯২ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত) ধরে একীভূত ছিল। তারা একই ভাষা এবং প্রয়োজনীয় একই সংস্কৃতির ধারা ভাগ করে নিয়েছিল। তবুও গত কয়েক দশক এবং তারও বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলকে ডেমিলাইট্রাইজ জোন (ডিএমজেড) হিসেবে বিভক্ত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জাপানি সাম্রাজ্যের পতন শুরু হওয়ার সাথে সাথে এই বিভক্তি করণ সম্পন্ন হয়। এ সময় আমেরিকা এবং রাশিয়া এ অঞ্চলে নিজ নিজ প্রভাব বিস্তারের স্বার্থে দ্রুতই এটাকে এক প্রকার নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। 

 

কোরীয় উপদ্বীপকে উত্তর এবং দক্ষিন অংশে বিভক্ত করা

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির সাথে সাথে মিত্রশক্তির কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তারা এ অঞ্চলে নির্বাচনের আয়োজন না করা পর্যন্ত এবং একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত কোরিয়াসহ জাপানের অধিকৃত অঞ্চলগুলি শাসন করবে।

মার্কিন সরকার ঠিকই জানত এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব বজায় রাখা কতটা জরুরী। একইসাথে, রাশিয়াও তার চিন্তাধারাকে একই খাতে প্রবাহিত করেছিল। 

 

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমায় একটি পারমাণবিক বোমা ফেলে। এর দু’দিন পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মনছুরিয়ায় আক্রমণ করে। উত্তর কোরিয়ার উপকূলে সোভিয়েত উভচর সৈন্যরাও তিনটি পয়েন্টে অবতরণ করেছিল।

৯ আগস্ট, যখন নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলা করা হয়, তখন সম্রাট হিরোহিতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে জাপানের আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

জাপান আত্মসমর্পণের ঠিক পাঁচ দিন আগে, দুইজন মার্কিন আধিকারিক ডিন রুস্ক এবং চার্লস বোনস্টিলকে পূর্ব এশিয়ার এ অঞ্চলকে নিজেদের দখলে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

কোরিয়ানদের পরামর্শের তোয়াক্কা না করে, এক প্রকার গায়ের জোরে ৩৮ ডিগ্রি অক্ষাংশকে সমান্তরালভাবে কেটে/ভাগ করে দেয়া হয়। আমেরিকা এটা এটি নিশ্চিত করে যে দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম শহর দক্ষিণের রাজধানী সিওল আমেরিকার অধীনে থাকবে। 

 

উত্তর কোরিয়ার জাপানি বাহিনী সোভিয়েতদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী আমেরিকানদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন কিছু রাজনৈতিক দল নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে দ্রুত তাদের নিজস্ব প্রার্থী প্রস্তুত করা শুরু করে এবং সিওলে একটি সরকার গঠনের পরিকল্পনা করে, তবে মার্কিন সামরিক প্রশাসন তখন চাইছিল তাদের মনোনীত প্রার্থী এখানে জয়ী হোক।

১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউএসএসআরের কিছু প্রশাসনিক বাক্তি চাইছিল যে, দুই কোরিয়া পুনরায় একত্রিত হোক, সে লক্ষে তারা দেশব্যাপী নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কথা চিন্তা করছিল।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরো উপদ্বীপটিকে গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী মতাদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিল, অপরদিকে, সোভিয়েতরা চাইছিল যে এগুলি সবই কমিউনিস্ট হোক। এভাবে উভয় পক্ষই আর  একে অপরের প্রতি আস্থা রাখেনি, ফলে এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

 

এ অবস্থা কোরীয় উপদ্বীপে একটি অচলাবস্থা তৈরি করে। এবং উভয় পক্ষের অর্থনীতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে  তোলে। বেশিরভাগ ভারী শিল্প ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি উত্তর অংশে ছিল এবং বেশিরভাগ হালকা শিল্প ও কৃষি সম্পদ ছিল দক্ষিণে। উত্তর এবং দক্ষিণ উভয়কেই একটি রাজনৈতিক কাঠামো পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিল, তবে এটি ভিন্ন রাজনৈতিক কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হবে। 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে শাসন করার জন্য কম্যুনিস্ট বিরোধী নেতা সিঙ্গম্যান রিকে নিয়োগ করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৪৮ সালের মে মাসে নিজেদেরকে একটি জাতি হিসাবে ঘোষণা করে। আগস্টে রিই প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন এবং একইসাথে দক্ষিন কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং তার বামপন্থী নীতির বিরুদ্ধে একপ্রকার স্নায়ু যুদ্ধ শুরু করে।

 

এদিকে, সোভিয়েতরা উত্তর কোরিয়ার কিম ইল-সং কে যুদ্ধের সময় সোভিয়েত রেড আর্মির মেজর হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং তাদের দখলকৃত অঞ্চলটির নতুন নেতা হিসাবে নিয়োগ করেছিল। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কিম ইল-সং আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন।

এর পরপরই কিম তার রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করতে শুরু করেছিলেন, বিশেষত যারা পুঁজিপতি ছিল তাদেরকে তিনি দমন করতে শুরু করেন এবং একইসাথে, তিনি তার বাক্তিগত বাহিনী তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের মধ্যে, কিম ইল-সং পুরো উত্তর কোরিয়া জুড়ে তার মূর্তি স্থাপন করা শুরু করেন এবং এর সাথে তিনি নিজেকে “মহান নেতা” বলে অভিহিত করেছিলেন।

 

কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধ

Korean_War_bombing_Wonsan
Korean_War

১৯৫০ সালে, কিম ইল-সং হঠাতই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে দুই কোরিয়াকে পুনরায় একত্রিত করার চেষ্টা করা হবে। সিদ্ধান্তের ফল স্বরূপ তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রমণ শুরু করেন, যা কোরীয় যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তিন বছরের দীর্ঘ সময় ধরে কোরিয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

এ সময় দক্ষিণ কোরিয়া জাতিসংঘের সমর্থন লাভকরে এবং আমেরিকার সেনাবাহিনী দক্ষিন কোরিয়ার হয়ে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল।

 

এই যুদ্ধ ১৯৫০ সালের জুন থেকে শুরু হয়ে ১৯৫৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এবং এতে ৩০ লক্ষেরও বেশি কোরিয়ান, মার্কিন সেনা এবং চীনা নাগরিক নিহত হয়েছিল। ১৯৫৩ সালের ২৭ শে জুলাই পানমুনজোমে(দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম) একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

এতে উভয় দেশই সম্মত হয় যে তারা ৩৮ তম অক্ষরেখা সীমা মেনে চলবে। উত্তর কোরিয়া কম্যুনিজম নীতি মেনে চললেও দক্ষিন কোরিয়া পুঁজিবাদী বাবস্থার দিকে মনোনিবেশ করে।

 

১৯৬৪ সালের মধ্যে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টির উত্তরের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয়, কৃষকরা সমবায় পদ্ধতি গ্রহন করে এবং সমস্ত বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়া দৃঢ়ভাবে কমিউনিস্ট-বিরোধী মনোভাব নিয়ে উদারপন্থী আদর্শ এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।

 

সোভিয়েত ইউনিয়নের ছায়ায় বাস করা উত্তর কোরিয়া ১৯৮৯ সালের পরে একটু খানি বিপদে পরে যায়, যখন এর কম্যুনিস্ট ব্লকটি হঠাৎ করে ভেঙে পড়ে। এবং এ অবস্থা আরও শোচনীয় রুপ ধারন করে যখন ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। এর ফলে উত্তর কোরিয়া তার প্রধান অর্থনৈতিক ও সরকারী সমর্থন হারায়। অর্থনৈতিক এ অচল অবস্থা উত্তর কোরিয়ার জন্য খারাপ বার্তা বয়ে নিয়ে আসে।

১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ায় এক বিশাল দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এসময় দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উত্তর কোরিয়াকে খাদ্য সহায়তার চেষ্টা করলেও, উত্তর কোরিয়ায় কমপক্ষে ৩,০০,০০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে, যদিও এ সংখ্যা আনুমানিক, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মৃতের সংখাটি ছিল অনেক বেশি।

 

২০০২ সালে, উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডরিয়ার ১২ গুণ বৃদ্ধি পায় ২০০৯ সালে, একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে উত্তর কোরিয়ার বাচ্চারা বেশি অপুষ্টিতে ভুগছে, এবং তাদের ওজন দক্ষিণ কোরিয়ার শিশুদের থেকে কম।

আসলে উত্তর কোরিয়া তার শক্তির যোগান দিয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে, আর দক্ষিন কোরিয়া সম্পূর্ণই বিপরিত পথে হেটেছে। এদের ভাষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আমেরিকা এবং রাশিয়ার প্রভাব বিদ্যমান।

 

সাধারনভাবে আমরা হয়তো বলতে পারি কোরীয় উপদ্বীপ স্বাধীন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাস্তব অবস্থা কি তাই?  

 

  তথ্যসুত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Korean_Demilitarized_Zone

https://en.wikipedia.org/wiki/North_Korea%E2%80%93South_Korea_relations

https://en.wikipedia.org/wiki/Korean_War

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top