ঘূর্ণিঝড় কি এবং কিভাবে সৃষ্টি হয়? ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কিছু প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়।

ঘূর্ণিঝড় কি এবং কেন সৃষ্টি হয়?

ঘূর্ণিঝড় হল ক্রান্তীয় সমুদ্র অঞ্চলে সৃষ্ট প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি রুপ, যেখানে বৃষ্টি, বজ্র এবং প্রচন্ড গতিতে বয়ে চলা বাতাসের একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। এবং যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এই ধরনের বাতাস ঝড়ের গতিতে ঘুরতে ঘুরতে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়। সমুদ্রে উৎপত্তি এ ঝড়কে অঞ্চলভেদে তিন টি নামে ডাকা হয়ে থাকে।নামগুলো হল, সাইক্লোন, হারিকেন এবং টাইফুন।

সাধারণত দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর/বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড়কে সাইক্লোন নামে ডাকা হয়। এছাড়া উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া ঝড়গুলোকে হ্যারিকেন নামে ডাকা হয়। এবং দক্ষিণ চীন সাগর বা জাপান সাগরে সৃষ্ট ঝড়কে টাইফুন নামে ডাকা হয়ে থাকে। এ যাবতকালে, এ ঝড়গুলোর যে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম রেকর্ড করা হয়েছে তাতে দেখা যায় সাইক্লোন থেকে হারিকেন এবং টাইফুন এর গতিবেগ ছিল অনেক বেশি।

 

প্রতি বছর সমুদ্রে ৭০-৮০ টি ঝড়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে এগুলোর বেশীরভাগই সমুদ্রেই বিলীন হয়ে যায়। যে সকল ঝড় ভুখন্ডে আঘাত হানে , সেগুলো হয় অনেক শক্তিশালী এবং ধ্বংসাত্মক। 

 

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা মটামুটি ২৬-২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর মধ্যে থাকলেই হয় এবং সমুদ্রের গভীরতা কমপক্ষে ৫০ মিটার হতে হবে। সাধারণত কর্কট ও মকর ক্রান্তিরেখার কাছাকাছির সমুদ্র অঞ্চলগুলোতে গ্রীষ্মকালে বা গ্রীষ্মের শেষে, আবার অনেক সময় শীতের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। আটলান্টিক মহাসাগরে হারিকেন এর মওসুম শুরু হয় সাধারণত ১ জুন থেকে, এবং এটি সেপ্টেম্বরের প্রথমদিক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

১৯৫০ সালের পর থেকে হারিকেনের সরকারী রেকর্ড সংরক্ষণ শুরু করার পর থেকে দেখা যায়,  আটলান্টিক মহাসাগরে বিভিন্ন নামে যে সমস্ত ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে তার ৬০% এর বেশি আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে সৃষ্টি হয়েছিল। 

আজকে এখানে আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বেশি প্রলয়ঙ্কারি কিছু ঝড় সম্পর্কে জানবো, যেগুলোর বাতাসের গতিবেগ আমাদের ভাবনায় ফেলতে বাধ্য। এখানে ১ মিনিটের আশেপাশে স্থায়ী হওয়া সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত বাতাসের গতিবেগ এবং ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রীয় চাপকে(সর্বোচ্চ ৯০০ মিলিবার এবং তার নিচে) গণনায় ধরা হয়েছে।

 

১০। টাইফুন ” অ্যামি “।

আমাদের ১০ নম্বর সিরিয়ালে রয়েছে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এ সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় টাইফুন “ অ্যামি “। যার সর্বাধিক বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৭২ মাইল এবং সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ ছিল ৮৯০ মিলিবার। এ্যামিকে ১৯৭১ সালের ২৯ শে এপ্রিল গ্রীষ্মমন্ডলীয় নিম্নচাপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং দ্রুত এটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের অবস্থানে পৌঁছে যায়। ১ মের প্রথম দিকে ঘূর্ণিঝড়টি তীব্রতর আকার ধারন করে একটি সুপার টাইফুনে রুপান্তরিত হয়। 

 

০৯। টাইফুন ” ইডা ” ।

পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর সৃষ্ট এ ঘূর্ণিঝড়টির নাম টাইফুন “ ইডা “। ১ মিনিটে সর্বাধিক টেকসই বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৭৩ মাইল (২৭৮ কিলোমিটার)। এবং সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ পরিমাপ করা হয় ৮৯০ মিলিবার। এটাকে কাটাগরি ৫ এর সুপার টাইফুন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

 

০৮। টাইফুন “ রিটা ”।

পূর্বের দুটি টাইফুনের মতো টাইফুন রিটাও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অববাহিকায় সৃষ্ট একটি ঝড়। এর সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ রেকর্ড করা হয় ৮৮০ মিলিবার এবং বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৭৫ মাইল (২৮১ কিলোমিটার)। প্রচন্ড শক্তিশালী এ ঝড়টি শুধু ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার দিক দিয়েই সেরা ছিল না, এটি অনেক দীর্ঘস্থায়ী ঝড়ের দিক দিয়েও অন্যতম ছিল।

প্রায় ২ সপ্তাহেরও বেশি দীর্ঘ সময় ধরে এটি কার্যকর ছিল। ফিলিপাইনে টাইফুন কেডিং নামে পরিচিত সুপার টাইফুন রিটা ১৯৭৮ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় টাইফুন মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়। এ ঝড়টি রেকর্ডের দিক দিয়ে অন্যতম তীব্র ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এটি গুয়াম, ফিলিপিন্স এবং ভিয়েতনামে আঘাত করট। এর ফলে ১০ কোটি ডলারের বেশি সম্পদের ক্ষতি সাধন হয়েছিলো এবং ৩০০ জন মানুষ এতে মারা যায়। এটাকে কাটাগরি ৪ এর সুপার টাইফুন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

 

০৭।  টাইফুন “ইরমা” ।

গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় ইরমার সূত্রপাত হয় ১৯৭১ সালের ২১ শে অক্টোবর অ্যাজোরের প্রায় ৫০০ মাইল (৮০০ কিলোমিটার) দক্ষিণ দিকে। ক্রান্তীয় নিন্মচাপ হিসেবে শুরু হয়ে পরের দু’দিনের মধ্যে, এটি সুপার সাইক্লোনে পরিনত হয়ে এর পরিধি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর সর্বাধিক গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৮০ মাইল (২৮৬ কিলোমিটার)। সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ ছিল ৮৮৪ মিলিবার। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট এ ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সেভাবে নিরুপন করা হয়নি, যদিও অ্যাজোরের আশেপাশের কয়েকটি দ্বীপে এটি আঘাত হানে।

 

০৬। টাইফুন “ জুন ”।

১৯৭৫ সালে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অববাহিকায় সৃষ্ট হওয়া এ ঝড়ের সর্বাধিক বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৮৫ মাইল (২৯৮ কিলোমিটার) এবং  সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ ছিল ৮৭৫ মিলিবার। মরসুমটিতে রেকর্ড হওয়া সবচেয়ে মারাত্মক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় গুলির মধ্যে একটি ছিল টাইফুন “ জুন ”। এতে উল্লেখ করার মতো কোনও ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এটি ভূমির বেশ কিছু অঞ্চল একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছিল।

 

০৫। টাইফুন “ টিপ ”।

টাইফুন টিপ, ফিলিপাইনে টাইফুন ওয়ার্লিং নামে পরিচিত। ১২ অক্টোবর ১৯৭৯ সালে এ ঝড়টি জাপান এবং গুয়ামে আঘাত করে। তৎকালীন রেকর্ড করা বৃহত্তম এবং সবচেয়ে তীব্র ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি। গুয়াম পার হওয়ার পরে, এটি আরও তীব্রতর আকার ধারণ করে। ঝড়ের সর্বাধিক বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘন্টায় ১৯০ মাইল (৩০৬ কিলোমিটার) এবং  সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ ছিল ৮৭০ মিলিবার।

বৃহত্তম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এ ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের ব্যাস ছিল প্রায় ২,২২০ কিমি (১,৩৮০ মাইল)। ঝড়ে খুব বেশি হতাহত না হলেও এই ঝড়ের ফলে ব্যাপক বন্যা হয়েছিল। ৪২ জন মানুষ এতে মারা যায়।

 

০৪। টাইফুন “ জোয়ান ”।

তীব্রতা এবং আকারের দিক থেকে টাইফুন জোয়ান ১৯৫৯ সালের টাইফুন মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় ছিল। এর ব্যাসার্ধ ছিল ১০০০ মাইলেরও বেশি। জোয়ান তাইওয়ানে আঘাত করেছিল ১৮৫ মাইলের বেশি বাতাসের গতিবেগ নিয়ে। এটার সর্বাধিক বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৯৫ মাইল (৩১৪ কিলোমিটার) এবং সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ ছিল ৮৮৫ মিলিবার।

 

০৩। টাইফুন ইডা (১৯৫৮) এবং হারিকেন প্যাট্রিসিয়া (২০১৫)।

এ দুটি টাইফুনেরই বাতাসের সর্বচ্চ গতিবেগ ছিল ২০০ মাইল (৩২৫ কিলোমিটার)। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট টাইফুন ইডা এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নবাগত হারিকেন প্যাট্রিসিয়া, রেকর্ড ইতিহাসে তৃতীয় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। ২০১৫ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে মেক্সিকোর দক্ষিণ উপসাগরে সৃষ্টি হওয়া প্যাট্রিসিয়া ২০ অক্টোবর প্রথম গ্রীষ্মমন্ডলীয় নিম্নচাপে রুপান্তর হয়। এবং মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে একটি ৫ ডিগ্রি হারিকেনের আকারে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

অনেকের মতে এটি  ১৯৫৮ সালের টাইফুন ইডার থেকেও শক্তিশালী ছিল (ঘন্টায় বাতাসের গতিবেগ ২১৫ মাইলের বেশি ছিল)। এটি পশ্চিম গোলার্ধের রেকর্ডে সবচেয়ে তীব্র ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী। হারিকেন প্যাট্রিসিয়ার প্রভাবে প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয় শুধুমাত্র মেক্সিকোতেই। এছাড়া টেক্সাস জুড়ে এটি তার ধ্বংস লীলা চালায়। কৃষি খাত, অবকাঠাম সহ বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমানে ক্ষতি হয় এ ঝড়ের কারনে।

২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮  টাইফুন ইডা জাপানে আঘাত করে। গুয়ামের কাছে সৃষ্টি হওয়া টাইফুন এর বাতাসের ঘন্টায় গতিবেগ ছিল ২০০ মাইল (৩২৫ কিলোমিটার) এবং সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ ছিল ৮৮৭ মিলিবার। । ইডার প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব জাপানে মুষলধারে বৃষ্টির ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি অনুমান করা হয় ৫ কোটি ডলার, এবং সেখানে ১২৬৯ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

 

০২। টাইফুন ” ভায়োলেট “।

আবারও সেই পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অববাহিকা, এবং আরও একটি সুপার সাইক্লোন। ৮৮৬ মিলিবারের কেন্দ্রীয় চাপ এবং প্রতি ঘন্টায় ২০৭ মাইল (৩৩৫ কিলোমিটার) গতিবেগে ধেয়ে আসা একটি ঝড় কি ক্ষতি করতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এমন তীব্র ঝড় হওয়ার জন্য, ভায়োলেট আশ্চর্যজনকভাবে স্বল্পস্থায়ী ছিল এবং জাপানে আঘাত হানার সাথে সাথে ঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং এতে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ের। ১৯৬১ সালে জাপানে আঘাত করা ঝড়টি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি করে এবং এতে মাত্র ২ জনের প্রানহানি ঘটে।

 

০১।   টাইফুন “ ন্যানসি “।

টাইফুন “ ন্যানসি “ কে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে সর্বাধিক বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২১৩ মাইল (৩৪৫ কিলোমিটার) এবং সর্বনিম্ন কেন্দ্রীয় চাপ ৮৮২ মিলিবার, যা রেকর্ড করা হয়। সুপার টাইফুন ন্যান্সি, দ্বিতীয় মুরোটো টাইফুন (ডেইনি-মুড়োটো তাইফ) নামেও পরিচিত।

 

এটি ১৯৬১-এর প্রশান্ত মহাসাগরীয় টাইফুন মৌসুমের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং রেকর্ডে্র দিক দিয়ে অন্যতম তীব্র ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়। এ ঘূর্ণিঝড় কে ২০১৫ সালের হারিকেন প্যাট্রিসিয়ার সাথে তুলনা করা হয়, যদিও প্যাট্রিসিয়ার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি, সে তুলনায় টাইফুন “ ন্যানসি “র ক্ষতির পরিমান তুলনামুলক কম ছিল। এ ঝড়ের প্রভাবে জাপানে ২০০ জনের প্রাণহানি ঘটে।

 

তথ্যসুত্রঃ-  https://www.throughtco.com

https://en.wikipedia.org/wiki/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top