চেরনোবিল (Chernobyl) হল বর্তমান ইউক্রেনের (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ) একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের এ স্থানটিতেই এক বিপর্যয়কর পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমাতে যে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিলো এটি ছিল তার চেয়ে ৪০০ গুণ বেশি বিকিরণ সম্পন্ন একটি বিস্ফোরণ।
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পরমাণু বিপর্যয়ে তাৎক্ষনিকভাবে দুই শ্রমিক মারা গিয়েছিল এবং কয়েক মাসের মধ্যে তীব্র বিকিরণের সংস্পর্শে এসে আরও কমপক্ষে ২৮ জন মানুষ মারা যায়। বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল, ফলে হাজার হাজার মানুষের স্বাস্থ্যের বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিতে শুরু করে। ক্যান্সার সহ আশেপাশের অনেক অঞ্চলের মানুষ বিভিন্নভাবে সে সময় ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছিলো।
চেরনোবিল (Chernobyl) বিপর্যয় কেবলমাত্র পারমাণবিক শক্তির ভয়কেই জাগিয়ে তুলেছিল তা নয়, এটি সোভিয়েত সরকার, সোভিয়েত জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের এক্ষেত্রে সামগ্রিক দক্ষতার অভাবকেও উন্মোচন করে দিয়েছিলো।
মেল্টটাউন এবং এর পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তেজস্ক্রিয় আবর্জনা সাফ করার জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছিলো। এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য শুধুমাত্র একটি প্রাথমিক শক্তির উত্সই নষ্ট হয়ে যায় নাই, বরং তাদের জাতীয় গর্বের জন্য এটি ছিল মারাত্মক একটা আঘাত।
তত্কালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ বলেছিলেন, ভেবেছিলাম চেরনোবিল (Chernobyl) মেল্টডাউন, “আমার পেরেস্ট্রোইকা চালুর ফলে সৃষ্ট ক্ষতির চেয়েও বেশি ছিল এবং সম্ভবত পাঁচ বছর পরে (১৯৯২ সালে) সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আসল কারণ ছিল।”
চেরনোবিলের অবস্থান
চেরনোবিল (Chernobyl), বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী শহর কিয়েভ থেকে ৮০ মাইল উত্তরে অবস্থিত। এখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম বৃহৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিলো। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অদূরে শ্রমিক এবং তাদের পরিবারকে থাকার জন্য একটি ছোট্ট শহর “প্রিপিয়েট” তৈরি করা হয়েছিল।
১৯৭৭ সালে চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু হয়, এবং সে সময় দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ১৯৮৩ সালের মধ্যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারটি চুল্লির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল, এবং পরবর্তী কয়েক বছরে আরও দুটি চুল্লি সংযুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
চেরনোবিলের দুর্ঘটনা যেভাবে ঘটেছিলো?
১৯৮৬ সালের ২৬ শে এপ্রিল রাত ১.২৩ মিনিট থেকে জরুরী জলজ শীতল করণ ব্যাবস্থা (emergency water cooling system) কার্যকর হবে কিনা তা নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে একটি রুটিন মাফিক পরীক্ষা শুরু করা হয়েছিলো।
এ কার্যক্রম শুরুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, একটি অনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। পরীক্ষার সময়, বিদ্যুত প্রবাহ অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যায়, যার ফলে এখানকার ৪নং চুল্লিতে বাষ্প আকারে চাপ তৈরি হয়ে চুল্লীতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ড্রাইভিংয়ের তাপমাত্রা ২ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়ে যায়। জ্বালানী রডগুলি গলে, চুল্লিটির গ্রাফাইটের আবরণকে জ্বালিয়েদেয় এবং তেজস্ক্রিয়তা বাস্পয়িত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এর প্রায় দুই থেকে তিন সেকেন্ড পরে, দ্বিতীয় আরেকটি বিস্ফোরণে অতিরিক্ত জ্বালানী ছাঁদের ফাকা অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসে। স্বয়ংক্রিয় সুরক্ষা ব্যাবস্থাগুলি সে সময় ঠিকমতো কাজ করেনি। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন যে, পরীক্ষার আগে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছিলো না।
বিস্ফোরণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই দমকলকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় এবং তেজস্ক্রিয়তা থেকে তাদের বাঁচাতে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যাবস্থা ছাড়াই আগুনের সাথে লড়াই করা শুরু করে। তীব্র তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে এদের প্রায় সবাই দুর্ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই মারা গিয়েছিল।
চেরনোবিল (Chernobyl) দুর্ঘটনা নিয়ে সিবিসি একটি ডকুমেন্টারি সিরিজ প্রকাশ করেছিলো, সেখানকার প্রতিবেদনে দেখা যায়, দমকলকর্মীরা যারা আগুনের সাথে লড়াই করেছিল তাদের বিবরণ থেকে জানা যায়, তখনকার বিকিরণ ছিল অনেকটা “ধাতুর স্বাদগ্রহণ” করার মতো এবং তারা বলেছিল তারা তাদের মুখে পিন বা সূঁচ ফোটানোর মতো ব্যথা অনুভব করেছিল। এর কয়েকদিন পরে, এই দমকলকর্মীদের মধ্যে অনেকেই মারা গিয়েছিলেন।
বিস্ফোরণের পরের দিন সকাল ৫ টায় ৩ নং চুল্লিটি বন্ধ হয়ে যায়, এবং এর প্রায় ২৪ ঘন্টা পরে, ১ এবং ২ নম্বর রিয়েক্টরদুটিও বন্ধ হয়ে যায়।
২৬ শে এপ্রিল বিকেলে সোভিয়েত সরকার এই বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাদের সৈন্যদের একত্র করেছিল। ৪ নং চুল্লি ভেঙে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলো এবং চুল্লির ছাঁদের কিছু অংশ টুকরো টুকরো হয়ে ছাঁদের অবশিষ্ট স্থানের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো এ সব টুকরোগুলোকে ঠান্ডা করা এবং চুল্লি ঠান্ডা রাখার জন্য উন্মুক্ত চুল্লীতে পানি স্প্রে করা হয়েছিল।
তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা হ্রাস করার জন্য বালু, সীসা এবং নাইট্রোজেন ব্যবহার করে সমস্ত আগুন নিভাতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগেছিল।
প্রিয়পিয়েট যেভাবে খালি করা হয়েছিল
তেজস্ক্রিয়তা পরিলক্ষিত করে পার্শ্ববর্তী শহর প্রিপিয়টেকে খালি করার সিদ্ধান্ত নেয় সোভিয়েত করতিপক্ষ। একসঙ্গে অনেকগুলো ট্রাক বিকিরন কমানোর জন্য এ শহরের বিভিন্ন স্থানে পরিষ্কার করার কার্যক্রম শুরু করে। প্রাথমিকভাবে খুব কম, মাত্র কয়েক মাইল দূরে বিপর্যয়ের লক্ষণ দেখা গিয়েছিলো। তবে কেউই বুঝতে পারছিলো না যে সামনে কি বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
পরের দিন ২৭ শে এপ্রিল, সরকার প্রিপিয়টের ৫০,০০০ বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া শুরু করে। বাসিন্দাদের বলা হয়েছিল, তারা মাত্র কয়েক দিনের জন্য দূরে কোথাও থাকবেন। তাই তারা তাদের সাথে খুব সামান্যই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়েছিলেন। বেশিরভাগ লোক কখনও জানতো না যে, তাদের আর কখনোই এ বাড়িতে ফিরে আসা হবে না।
দুর্ঘটনার বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপনীয়তা
সোভিয়েত নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ঘটনাটি জানাতে কয়েক দিন দেরি করেছিলো, কিন্তু এরই মধ্যে অনেক বিপর্যয় ঘটে যায়। স্টকহোমের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অপারেটররা যখন তাদের প্ল্যান্টের নিকটে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চমাত্রার বিকিরণ টের পান, তখন সুইডিশ নেতাদের পক্ষ থেকে কোনও ব্যাখ্যা দাবি না করা পর্যন্ত সোভিয়েত সরকার বিশ্বব্যাপী চেরনোবিল দুর্ঘটনার বিষয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।
অবশেষে, ২৮ শে এপ্রিল, ক্রেমলিন জানিয়েছিল যে, চেরনোবিলে (Chernobyl) একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ এটি দেখভাল করছে। এই বিবৃতির পরে একটি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত কিছু খবর এরকম ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি দ্বীপে সংঘটিত পারমাণবিক দুর্ঘটনা এবং পশ্চিমা দেশগুলির অন্যান্য পারমাণবিক দুর্ঘটনার মতোই এটি একটি স্বাভাবিক দুর্ঘটনা।
এর তিন দিন পরে, সোভিয়েত ইউনিয়নে যথারীতি মে দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো এবং এখানে অংশ গ্রহণকারীরা দিবস টি উৎযাপনের জন্য মস্কো, কিয়েভ এবং বেলারুশের রাজধানী মিনস্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। সোভিয়েত সরকার চেরনোবিলের ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয়তার বিষয়টি জানলেও শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে বিধায় এরকম একটি ঘটনা ঘটতে দিয়েছিলো।
এমনকি ইউক্রেনের বেশিরভাগ লোকেরা দুর্ঘটনা, মৃত্যু এবং প্রিয়পিয়াতের বাসিন্দাদের তাড়াহুড়ো করে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়েও কাউকে অবগত করেছিল না।
চেরনোবিলের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এবং হতাহতের বিবরন
ক্ষতিগ্রস্থ আয়োডিন -১৩১, সিজিয়াম -১৩৭, প্লুটোনিয়াম এবং স্ট্রোটিয়াম-৯০ সহ প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ দুর্ঘটনার মাত্র ১০ দিনের মধ্যে প্রচুর পরিমানে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। তেজস্ক্রিয়তার মেঘ ইউক্রেন, বেলারুশ, রাশিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল এবং ইউরোপের অন্যান্য অংশেও বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে, ১৪ ই মে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ পরিচ্ছন্নতার কাজে সহায়তার জন্য দমকলকর্মী, সামরিক সংরক্ষণবিদ ও খনি শ্রমিক সহ কয়েক সহস্রাধিক লোককে চেরনোবিলে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
ইউক্রেনের সরকার ১৯৯৫ সালে এক ঘোষণা বার্তায় বলেছিল, চেরনোবিল (Chernobyl) বিকিরণের প্রভাবে ১২৫,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। ২০০৪ সালে জাতিসংঘের চেরনোবিল ফোরামের এক প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছিল যে দুর্ঘটনার পরের মাসে ৫০ জনেরও কম লোক মারা গিয়েছিল। এখানে আরও বলা হয়, চেরনোবিলের রেডিয়েশনের সংস্পর্শে শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত ৯,০০০ মানুষ মারা যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছিলো।
২০০৫ সাল অবধি, সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের মতামত অনুসারে, প্রায় ৬,০০০ মানুষ থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং ১৫ টি থাইরয়েড ক্যান্সারের ফলে মৃত্যুর কারণ চেরনোবিলকে দায়ী করা হয়েছিল।
চেরনোবিল (Chernobyl) বিপর্যয়ের স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলি অনেকটাই অস্পষ্ট রয়ে গেছে, প্রাথমিকভাবে ৩০ জন মানুষ ছাড়াও সোভিয়েত সরকার বিস্ফোরণ এবং তীব্র বিকিরণের ফলে সামান্য কিছু মানুষ নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। খনি শ্রমিক, অগ্নি নির্বাপক কর্মী এবং চেরনোবিলের নিকটবর্তী জনগোষ্ঠীর উপর এর প্রভাবগুলি মূল্যায়নের জন্য বিস্ফোরণের পরে সরকারীভাবে কোন গবেষণা করা হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটস-এর ২০১১ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, চেরনোবিল ফলআউট থেকে তেজস্ক্রিয় আয়োডিন -১৩১ এর সংস্পর্শে যারা এসেছিলো, তারা সম্ভবত থাইরয়েড ক্যান্সারে ভুগছিল এবং এখনও বিভিন্ন সময় শিশু বা কৈশোর প্রাপ্ত লোকদের মধ্যে এ লক্ষন দেখা যায়।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার প্রভাব কি ছিল?
চেরনোবিল (Chernobyl) দুর্ঘটনার জন্য প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছিল। কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, এটি সম্ভবত সোভিয়েত সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। দুর্ঘটনার পরে, সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ নিকটস্থ প্রিয়পিয়তের সমস্ত (৫০,০০০ মানুষ) মানুষসহ এর নিকটবর্তী অঞ্চলের আরও ৩,৫০,০০০ এরও বেশি জনগনকে পুনর্বাসিত করেছিল। তবে আশঙ্কার বিষয় হল এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষ এ দূষিত অঞ্চলে বসবাস করে চলেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে, এই অঞ্চলের জীবনযাত্রার উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত অনেক প্রকল্প বাতিল করা হয় এবং এখানে নিয়োজিত কর্মীরা অন্যান্য জায়গায় নতুন জীবন গড়ার উদ্দেশ্যে সরে যেতে শুরু করে। সেখানে এমন অনেক গ্রাম ছিল, যেখানে ৬০ শতাংশ মানুষ শুধুমাত্র পেনশনের উপরে নির্ভর করে তাদের জীবন অতিবাহিত করতো।
মিনস্কের বেলারাদ রেডিয়েশন সেফটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ইনস্টিটিউটের (Belrad Radiation Safety and Protection Institute in Minsk) পরিচালক ভ্যাসিলি নেস্টেরেনকো বলেছেন “এখানকার বেশিরভাগ গ্রামে, কাজ করতে সক্ষম লোকের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই বা তিনগুণ কম”।
দুর্ঘটনার পরে, ৪ নম্বর চুল্লিটি সিল করে দেওয়া হয়েছিল, তবে ইউক্রেন সরকার অন্য তিনটি চুল্লিটিকে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়, কারণ তাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন ছিল। ১৯৯১ সালে ২ নম্বর চুল্লিটি বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৯৯ সালে চুল্লি নং ১ এর কার্যক্রমও বাতিল করা হয় । ২০০০ সালের নভেম্বরে, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি একটি অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ নং চুল্লি বন্ধ করে দেন এবং এরই মাধ্যমে অবশেষে চেরনোবিল বন্ধ হয়ে যায়।
চুল্লি নং ৪, যা ১৯৮৬ সালের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, সেটি এখন একটি কংক্রিটের আবরণের অভ্যন্তরে আবদ্ধ তেজস্ক্রিয় পদার্থে পূর্ণ, একটি সরোকফ্যাগাস (sarcophagus) নামে পরিচিত।
সারকোফাগাসটি প্রায় ৩০ বছর ধরে চলার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে যে ডিজাইনগুলি করা হয় তা সাধারণত ১০০ বছর স্থায়ী। তবে বর্তমানে অনেক দেশই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের দিকে ঝুকছে, (বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম নয়) তাতে তেজস্ক্রিয়তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটিকে কমপক্ষে ১,০০,০০০ বছর এর নিরাপত্তা থাকা প্রয়োজন। এটি কেবল আজকের নয়, আমাদের আগত প্রজন্মের জন্যও একটি চ্যালেঞ্জ।
চেরনোবিলের বর্তমান অবস্থা
চেরনোবিলের দুর্ঘটনা সেখানকার চিরচেনা মানুষের অনেক দূরে পাঠিয়েছে এটা সত্যি, তবে এটা ছাড়াও চেরনোবিল (Chernobyl) দুর্ঘটনার রেডিয়েশন একটি বিশাল অঞ্চলকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে।
সাইটটির চারপাশের ৭৭০ বর্গমাইল এলাকা বর্তমানে মানুষের আবাসনের জন্য অনিরাপদ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং দূষিত গাছপালা ও মাটির কারণে কৃষিকাজে এখানকার জমি ব্যবহার করার অনুপযুক্ত। তবে, ২০১৭ সালে কিছু মানুষ এই অঞ্চলটি ব্যাবহারে জন্য একটি নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছেন।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে, ইউক্রেন-জার্মানির সৌর বিদ্যুত সংস্থা চেরনোবিলের (Chernobyl) পরিত্যক্ত অঞ্চলে একটি বিশাল সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ রিঅ্যাক্টর ৪ থেকে কয়েকশ ফুট দূরে নির্মিত এক-মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে ৩,৮০০ ফটোভোলটাইক প্যানেল (সৌর প্যানেল) লাগানো হয়েছিল। ইউক্রেনীয় সরকার বলেছে যে এখান থেকে আরও ৯৯ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।
এদিকে, ২০১৬ সালের এপ্রিলে চালানো এক গবেষণা অনুসারে দেখা যায়, চেরনোবিল সাইটে নেকড়ে, বিভার এবং বাইসন সহ বন্যজীবনগুলি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হওয়ার লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করেছে।
গবেষকরা উল্লেখ করেছিলেন যে রেডিয়েশনের সংস্পর্শ প্রাণীর পক্ষে ভাল নাও হতে পারে, তবুও মানুষের অনুপস্থিতির বেনিফিট রেডিয়েশনের ঝুঁকিকে অনেক সময় ছাড়িয়ে যায়।
তবে এটা খুব ভালো ভাবেই আশা করা যায়, মানুষ খুব শীঘ্রই এই অঞ্চলটিতে পুনরায় তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারবে না। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ বলেছে যে, চেরনোবিল এক্সক্লুশন জোন ২৪,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের বসবাসের জন্য পৃথিবীর অন্যতম অনিরাপদ যায়গা হিসেবে বিবেচিত হবে।
এতদসত্তেও আজ এ সাইটিতে কিছু পর্যটকের আনাগোনা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষকরে প্রিপিয়াত তাদের কাছে অন্যতম আগ্রহের স্থান।
তথ্যসূত্রঃ- https://www.history.com/topics/1980s/chernobyl
https://www.thoughtco.com/chernobyl-nuclear-disaster-1779770
https://www.history.com/news/chernobyl-nuclear-disaster-7-people-who-played-crucial-role
https://en.wikipedia.org/wiki/Chernobyl_disaster
https://www.world-nuclear.org/information-library/safety-and-security/safety-of-plants/chernobyl-accident.aspx