চেঙ্গিস খান এবং চরম প্রতাপশালী মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বিস্তার।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে চেঙ্গিস খান এবং মঙ্গোল সাম্রাজ্য বিশ্বের ইতিহাসে অনেক বড় একটি ভুমিকা পালন করেছিল, তা আমরা সবাই জানি। এশিয়ার যাযাবরদের একটি অপরিচিত গোষ্ঠী কিভাবে ১২০৬ থেকে ১৩৬৮ সালের মধ্যে এশিয়া এবং ইউরোপের অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে মঙ্গোল সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়েছিল এটা তার ইতিহাস। মঙ্গোলরা

এশিয়ায় সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো – মঙ্গোল সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খান (চিংগুস খান) এর নেতৃত্বে মঙ্গোলরা তাদের শক্তিশালী ছোট ঘোড়ার পিঠে চেপে প্রায় ২,৪০,০০,০০০  বর্গকিলোমিটার (৯৩,০০,০০০ বর্গ মাইল) ইউরেশিয়ান অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়েছিল। 

তবে প্রথম দিকে মঙ্গোলদের অবস্থা এমন ছিলো না। নিজেদের গোত্রের মধ্যেই তারা প্রায়শই  অশান্তি ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হতো। স্বার্থের দ্বন্দ্ব তাদের অনেক সময়ই রক্তাক্ত করেছিল। এ সকল অবস্থা সত্ত্বেও ১৬০ বছর ধরে মঙ্গোলরা তাদের সাম্রাজ্যর বিস্তৃতি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং তারা মঙ্গোলিয়ায় ১৬০০ সাল এর শেষভাগ পর্যন্ত তাদের শাসন বজায় রেখেছিল। 

 

মঙ্গোল সাম্রাজ্যর শুরুর দিক

১২০৬ সালের আগে কুরলতাই (মঙ্গোলদের উপজাতি কাউন্সিল) নামে একটি মঙ্গোল সংগঠন তেমুজিনকে (পরে চেঙ্গিস খান নামে পরিচিত) তাদের সর্বজনীন নেতা হিসাবে নিয়োগ করেছিল। এই নির্বাচন মঙ্গোল জাতিকে শুধুমাত্র বিপদজনক আন্তঃসীমানার লড়াই থেকেই রক্ষা করেনি, নিজেদের ছোট বংশের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বড় ভুমিকা পালন করেছিল।

আইন ও বিভিন্ন সংস্থায় তাঁর ক্যারিশমা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাধারা চেঙ্গিস খানকে তাঁর সাম্রাজ্য দ্রুতগতিতে সামনের দিকে প্রসারিত করার প্রেরনা জুগিয়েছিল।

১২১৮ সাল অবধি  চেঙ্গিস খানের মঙ্গোল সাম্রাজ্যর প্রসার বা বিশ্বকে জয় করার কোনও ইচ্ছাই ছিল না, কিন্তু যখন খুয়েরিজম শাহ একটি মঙ্গোল প্রতিনিধি দলের বাণিজ্য পণ্য বাজেয়াপ্ত করে এবং মঙ্গোল দূতদের ফাঁসি দেয় তখন চেঙ্গিস খান তার মানসিকতা পরিবর্তন করে ফেলে।

তৎকালীন ইরান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তানের শাসকের এই অপমানের কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে মঙ্গোল সেনারা পশ্চিমের দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে তাদের সমস্ত বিরোধী পক্ষকে ধাওয়া করে এবং পরাজিত করতে সক্ষম হয়। মঙ্গোলদের কিছু নতুন রণ কৌশল, নতুন নতুন অঞ্চল দখলের ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা পালন করে। এই দক্ষতাগুলি মধ্য এশিয়া জুড়ে এবং মধ্য প্রাচ্যে তাদের ভাল অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিল। 

চেঙ্গিস খানের অধীনে, মঙ্গোল সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্যের কিছু অংশ এবং পূর্বে কোরিয়ান উপদ্বীপের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কোরিয়ার গরিও কিংডম সহ ভারত ও চীনের প্রাণকেন্দ্রগুলি সেই সময়ের জন্য মঙ্গোল সাম্রাজ্যর আওতাধিন ছিল। 

 

চেঙ্গিস খানের মৃত্যু এবং পরবর্তী মঙ্গোল শাসন 

চেঙ্গিস খানের মূর্তি
চেঙ্গিস খানের মূর্তি

১২২৭ সালে, চেঙ্গিস খান মারা যান এবং তার সাম্রাজ্যকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়, এবং নির্ধারণ করা হয় যে এগুলো তার পুত্র এবং নাতি দ্বারা শাসিত হবে। এ অঞ্চলগুলি ছিল রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের গোল্ডেন হোর্ডের খানাট; মধ্য প্রাচ্যের ইলখানাতে (যার মধ্যে বাগদাদ  নগরী অন্তর্ভুক্ত); মধ্য এশিয়ার ছাগটাই খানাতে; এবং মঙ্গোলিয়া, চীন এবং পূর্ব এশিয়ার গ্রেট খানের খানাট।

১২২৯ সালে, ‘কুড়লতাই’ চেঙ্গিস খানের তৃতীয় পুত্র, ওগাদেইকে তার উত্তরসূরি হিসাবে নির্বাচিত করেছিল। নতুন খান  প্রতিটি দিক দিয়ে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটাতে থাকলেন, এবং মঙ্গোলিয়ার করাকরুমে একটি নতুন রাজধানী শহরও প্রতিষ্ঠা করলেন।

পূর্ব এশিয়ায় উত্তর চীনা জিন রাজবংশ ১২৩৪ সালে খানের বশ্যতায় আসে। এরপর, ওগেদয়ের সেনাবাহিনী পূর্ব ইউরোপের দিকে অগ্রসর হয় এবং কিয়েভের প্রধান শহর সহ রাশিয়ার (এখন রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশ অঞ্চলের) বিভিন্ন রাজ্যগুলো জয় করা শুরু করে।

আরও দক্ষিণে, মঙ্গোলরা পার্সিয়া, জর্জিয়া এবং আর্মেনিয়াকেও ১২৪০ সালের মধ্যেই দখল করে নেয়। ১২৪১ সালে, ওগেদেয় খান মারা যান এবং সেই সাথে ইউরোপ বিজয়ের অব্যাহত ধারা থমকে যায়।

ওগাদেইয়ের মৃত্যুর পর মঙ্গোল সাম্রাজ্য কিছুটা অস্থিরতার মধ্যদিয়ে গিয়েছিল, এ সময় অনেকেই ওগাদেইয়ের পুত্র গিয়ুক খানের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু তার চাচা এতে বাঁধা দেন, ফলে মঙ্গোলরা সে সময় একটানা চার বছর ধরে গ্রেট খানের শাসন ছাড়াই ছিল। 

 

গৃহযুদ্ধ আটকানো

১২৪৬ সালে অবশেষে আবার একটি গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়। চাচা বাতু খান আসন্ন গৃহযুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ গ্রহন করেন এবং গিয়ুক খানের নির্বাচনের পক্ষে একমত হন। কিন্তু সময়টি গিয়ুক খানের জন্য ভাল ছিল না, পার্সিয়ার অ্যাসাসিন বা হাশাশিন জাতি তাকে সম্রাট হিসেবে অস্বীকার করে।

এর মাত্র দুই বছর পরে, ১২৪৮ সালে মদ্যপান বা বিষক্রিয়াজনিত কারণে মারা যান গিয়ুক খান। তখন অনেকেই এ মৃত্যুকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছিল।

যাইহোক,  ১২৫১ সালে কুরলতাই আনুষ্ঠানিকভাবে চেঙ্গিসের নাতি এবং তলুইয়ের পুত্র মোংকে খানকে নতুন মহান খান হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন। মোংকের অধীনে, মঙ্গোলরা মধ্য প্রাচ্যে তাদের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছিল, পাশাপাশি চীনা সং রাজবংশ জয় করার চেষ্টাও করা হয়েছিলো।

মোংক খান ১২৫৯ সালে সং রাজবংশের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার সময় মারা যান এবং আরও একবার মঙ্গোল সাম্রাজ্যের নতুন প্রধান নির্বাচন করার প্রয়োজনীতা দেখা দেয়।

 

গৃহযুদ্ধ এবং কুবলাই খানের উত্থান

চেঙ্গিস খানের আর এক নাতি কুবলাই খান ক্ষমতা গ্রহণের আগে মঙ্গোল সাম্রাজ্য এক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পরে। তবে তিনি এক কঠোর লড়াইয়ের মাধ্যমে তার চাচাত ভাই আরিকবকি কে ১২৬৪ সালে পরাজিত করেছিলেন এবং সাম্রাজ্যের লাগাম নিজের হাতে নেন।

১২৭১ সালে, মহান কুবলাই খান নিজেকে চীনের ইউয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ঘোষণা করেন এবং অবশেষে সং রাজবংশকে জয় করার জন্য আন্তরিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহন করেন।

সর্বশেষ সং সম্রাট ১২৭৬ সালে কুবলাই খানের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং এর মাধ্যমে সমস্ত চীন জুড়ে মঙ্গোলদের বিজয় নিশ্চিত হয়। এ সময় কোরিয়াও ইউয়ান সাম্রাজ্যকে শ্রদ্ধা জানাতে  বাধ্য হয়েছিল। তিনি বার্মা, আনাম (উত্তর ভিয়েতনাম), চম্পা (দক্ষিণ ভিয়েতনাম) এবং সখালিন উপদ্বীপকে ইউয়ান (চীনের) সাম্রাজ্যের শাখা হিসেবে নিজের অধীনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

 

কুবলাই খানের মৃত্যু এবং নতুন খানের উত্থান 

কুবলাই খান ১২৯৪ সালে মারা যান এবং ইউয়ান সাম্রাজ্য কুড়লতাই এর মতামত ছাড়াই কুবলাই খানের নাতি তেমনুর খানের অধীনে চলে যায়। সে সময় ইলখানাতে নতুন মঙ্গোল নেতা গাজান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মধ্য এশিয়ার ছাগাতাই খানতে এবং ইলখানাতে ইউয়ান সমর্থিত একটি  যুদ্ধ শুরু হয়। সোনার জোড়ের শাসক ওজবেগও একজন মুসলমান ছিলেন।

এমতাবস্থায়, ১৩১২ সালে মঙ্গোলরা পুনরায় গৃহযুদ্ধ শুরু করে এবং ১৩৩০ এর দশকের মধ্যে, মঙ্গোল সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায়। 

 

একটি মহান খান সাম্রাজ্যের পতন 

১৩৩৫ সালে, মঙ্গোলরা পারস্যের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। দ্য ব্ল্যাক ডেথ (প্লেগ রোগ) সমগ্র এশিয়া জুড়ে মঙ্গোলের বাণিজ্য পথগুলিতে ছড়িয়ে পরে এবং অনেক শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়। গোরিয়েও কোরিয়া ১৩৫০ এর দশকে মঙ্গোলদের অস্বীকার করে।

১৩৬৯ সালের মধ্যে, সোনার জোড় পশ্চিমে বেলারুশ এবং ইউক্রেন এর শাসন হারায়, একই সময় ছাগাতাই খানতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ১৩৬৮ সালে, ইউয়ান রাজবংশ চীন থেকে তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং হান চিন মিং রাজবংশের উত্থান ঘটে।

চেঙ্গিস খানের বংশধররা মঙ্গুসের কাছে পরাজিত হওয়ার পরেও ১৬৩৫ সাল অবধি মঙ্গোলিয়ায় রাজত্ব চালিয়ে যায়। যাইহোক, তাদের দুর্দান্ত রাজ্য, বিশ্বের বৃহত্তম সংমিশ্রিত স্থল সাম্রাজ্য, দেড় শতাধিক বছর ধরে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পরেও চৌদ্দ শতকের দিকে মূলত একেবারেই এটা পৃথক হয়ে পড়েছিল। এবং এভাবেই একটি মহান খান সাম্রাজ্যের পতন হয়।

 

তথ্যসুত্রঃ- https://en.wikipedia.org/wiki/Genghis_Khan

https://www.britannica.com/biography/Genghis-Khan

https://www.ancient.eu/Genghis_Khan/

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top